সমালোচনা দ্য সেলফিশ জিনি : রিচার্ড ডকিন্স

The_Selfish_Gene3

মানুষ কি শুধু স্বার্থপর হয়, নাকি পরোপকারীও হয়?

সমুদ্রের জলে নামার আগে পেঙ্গুইনরা কিছুক্ষণ পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন তারা অপেক্ষাকৃত দুর্ব্বল পেঙ্গুইনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, এটা বোঝার জন্য সীল মাছ ওখানে আছে কি না? কারণ, সীল মাছ ওই পেঙ্গুইনটাকে খেয়ে ফেলে। এতে মনে হচ্ছে প্রাণী সেলফিস। এর বিপরীতে পরোপকারের নজিরও দেখতে পাই। মৌমাছি সবাই কিন্তু কামড় দেয় না। কিছু মৌমাছি মধুর চাককে পাহারা দেওয়ার জন্য অতিউচ্চ তাপমাত্রা (46°C) তৈরি করে যেটাকে ‘hot defensive balls’ বলে। এভাবে অন্যান্য প্রাণী থেকে চাককে মেহফুজ রাখে। এদের kamikaze bee fighters বলে। সমস্যা হল এরা নিজেরা মৃত্যুবরণ করে এর জন্য। বিনিময়ে নিজের আবাস তথা কলোনীকে হেফাজতে রাখে।

ডকিন্স-এর মতে, মানুষও অন্যান্য প্রাণীর মত। স্বভাবতই সেলফিস বা স্বার্থপর হয়। নিজ স্বার্থপূরণের জন্য সবকিছু করে। এবং এ স্বার্থপরতার জন্যই মানুষ altruistic behavior পরোপকার আচরণ দেখায়। যে selfish gene-টা মানুষকে স্বার্থপর করে সেটাই আবার altruistic nature দেখায় অন্যের প্রতি।

নিজের জিন(ডিএনএ) অন্যের সাথে যত শেয়ার করে সে তত তার প্রতি জৈবিক টান, মমতা অনুভব করে। এজন্য নিজপরিবার, বংশের প্রতি একধরনের স্বার্থপরতা, মমতাবোধ একটু বেশী। এটাকে জীববিজ্ঞানী ডকিন্স ‘সেলফিস জিন’ নাম দেন। উঁনার মতে, এ জিনের প্রভাবেই মানুষ যেমন নিজেকে বেশী ভালবাসে, তেমনি তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, এমনকি অন্যান্য প্রাণীদের প্রতিও স্বার্থপরতা, দায়বদ্ধতা, নৈতিকবোধ কাজ করে। কারণ, আপনি, আমি সকল জীবই এই সেলফিস জিন শরীরে বহন করে চলি।

উদাহরণ দেয়া যায়—
এক ডলফিন আরেক ডলফিন অসুস্থ হলে তাকে ধাক্কা দিয়ে ডাঙ্গায় আলো,বাতাসে আনে সুস্থতার জন্য। শিম্পাঞ্জি বা গরিলাদের কেউ অসুস্হ হলে দলবদ্ধভাবে সেবা করে। এমনকি এদের মাঝে ডাক্তারও আছে যারা বনের ঔষধি গাছ ব্যবহার করতে জানে।

মানুষের মা বাবা যেমন নিজের জীবন বিপন্ন করেও বাচ্চাদের রক্ষা করে, তেমনি বুনো মোষেরাও শিং উচিয়ে নিজেদের গোত্রের বাচ্চাদের শিকারীদের হাত থেকে রক্ষা করে, প্রাণ গেলেও। কারণ এই সেলফিস জিন। প্রাণীরা সবসময় নিজের জিনকে পরবর্ত্তী বংশের মাধ্যমে সুরক্ষিত রাখতে ও বিস্তার করতে চায়। তাই তো নিজের জিনকে
সুরক্ষিত করার জন্যই বাহুবলীর টাম্মা নিজে ডুবে গিয়ে বাচ্চাকে রক্ষা করে।

প্রশ্ন জাগে মানুষ কি শুধুই অন্যান্য প্রাণীর মত নিছক সেলফিস জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? কারণ, তার রয়েছে সভ্যতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, অর্থনীতি, মিথ, ধর্ম্ম, সমাজতত্ত্বের মত অনেক উপাদান যা তাদের নিয়ন্ত্রণ করে।

মানুষ সাধারণত দেখা যায় নিজ গোত্র, গোষ্ঠী, জাতি, ধর্ম্মের আদর্শ, নিয়মকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবী করে। অন্যেরটা খাটো করে দেখে। আশলে মানুষ ছোট বেলা থেকেই তার মা বাবা, পরিবেশ, গোষ্ঠী থেকে যা শিখে, শোনে, যে বিশ্বাস অর্জ্জন করে তা-ই তার মনের ভেতর ঝেঁকে বসে এবং এটা একজন থেকে আরেকজনের মনে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে একটা community belief এ পরিণত হয়। এবং এরা এটা অন্য গোত্রের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। এটা ডকিন্স ‘meme’ বলে অভিহিত করেন। মিম হল সংস্কৃতির অনুকরণ যা মন থেকে মনে বিস্তার লাভ করে।
আজকের বর্ণবাদ, ফেনাটিসিজম আর কিছু না মিম এর ফলাফল।

মানুষ বিবর্ত্তন পথ ধরে হেঁটে এলেও গত ১০,০০০ বছরে মানুষের কগনেগিভ রিভ্যুলুশনের পর কৃষিবিপ্লব, সভ্যতা, সংস্কৃতির বিকাশ, মিথ, ধর্ম্ম সবকিছুর মিথস্ক্রিয়া তার মাঝে ঘটেছে। এর মধ্যে সাংস্কৃতিকভাবেই বেশী পরিচালিত হয়েছে। আমাদের ভাষা, ধারনা, গান, শিল্প, পোষাক, ভূষণ, ডায়েট— এসব জেনেটিক আচরণ নয়। এটা মানুষ ইতিহাসের ক্রমধারায় সভ্যতার বিকাশে এক ব্যক্তির মন থেকে অন্য ব্যক্তির মনে, গোত্র থেকে গোত্রে ছড়িয়ে পড়েছে যার প্রভাব অনেক আমাদের জীবনে। যেমন অনেকে celibacy জীবন কাটায়। এটা gene এর বিপরীত আচরণ। ধর্ম্মীয় অনেক অনুশাসন অনেকে কঠোরভাবে পালন করে, কেউ কেউ স্থুল ধারণা, কুসংস্কারকে চরম আদর্শ মেনে এর জীবন দিতেও দ্বিধাবোধ করে না। এটা আশলে তাদের মনে প্রোথিত করা নির্দ্দিষ্ট একটা কওম বা গোত্রের বিশ্বাস। এটা জেনেটিক নয়। মীম কমপ্লেক্স। ডকিন্স এর মতে এর ভাল, খারাপ দুটো দিকই আছে। সক্রেটিস, লিওনার্দো, দেকার্তে, আইনস্টাইন এবং কবি, সাহিত্যিকদের ধ্যান, ধারণা এই meme complex এর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এক শতাব্দী থেকে আরেক শতাব্দীতে মন থেকে মনে।

ডকিন্স meme এর প্রভাব নিয়ে বেশ বিস্তারিত বলেছেন। বিভিন্ন আইডোলজি, বিশ্বাস, কুসংস্কার এর পিছনে meme দায়ী বলে বিশ্বাস করেন।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে কোন্টা বেশী ডমিনেইট করে? জিন না কি মিম? বস্তুত: একটা আরেকটার পরিপূরক। আমাদের কিছু আচরণের জন্য জিন দায়ী। আবার মিমও দায়ী। যেমন: জীববিজ্ঞানী ডকিন্স বলেন ‘বহুগামী, পরকীয়া জীবের জিনেই আছে। ৭০,০০০ বছর আগে মানুষের যখন বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব হয়, তখন শিকারী মানুষরা কোন জায়গায় স্থায়ী ছিল না। নারী বা পুরুষ উভয়ই বিভিন্ন জায়গায় বিচরণ করত এবং বহুগামী স্বভাব তৈরি হয়। এতে বুঝা যায় দীর্ঘদিনের আচরণ meme হিশেবে যেটা কাজ করে তা একসময় জেনেটিক্যালি বংশপরম্পরায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মে পৌঁছতে পারে।

তাছাড়া, অন্যান্য প্রাণীর জগতে নারী, পুরুষ উভয়ের মাঝে পরকীয়া, বহুগামী দেখা যায়। তবে নারীরাই পরকীয়ায় ব্যস্ত বেশী। মাছদের মাঝে তো ঘর সংসার পুরুষরাই দেখে, নারীরা ডিম পেড়ে অন্য মাছের কাছে চলে যায়, খাইয়ে দাইয়ে বড়ো করার দায়িত্ব বাপের। রাণী মৌমাছি, মাকড়সা, পিঁপড়ার সাথে তো অনেকগুলো পুরুষ মৌমাছি প্রেম করতে গিয়ে মারা যায়। আবার পুরুষ সিংহ বসে বসে খায় আর নারীরা সারাদিন খাবার সংগ্রহ করে, পুরুষ সিংহের সাথে সঙ্গম করার জন্য লড়াই করে।

আমাদের সমাজের মত, অন্য প্রাণীরাও তাদের সন্তানদের দেখভাল নিজেরা না করে, ধাত্রী বা পালক মা খুঁজে বের করে। কোকিলদের অন্ততঃ ৫০টা প্রজাতি অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে, দশটি প্রজাতির মৌমাছি, চারটি প্রজাতির বাবুই পাখি। এমনকি সারস পাখিদের যে খ্যাতি আছে সৎ দাম্পত্য জীবনের, তারাও দুম করে এনে ফেলে আরেকটা বউ। প্রাক্তন স্ত্রী যখন বাসায় বাচ্চা ফেলে চলে যায় অন্যত্র, আবার ফিরে এসে স্ত্রী সারস কর্ত্তামশাইয়ের দ্বিতীয় বউ দেখে দু’জনে লড়াইয়ে যে জিতে তার সাথেই সংসার করে।

তবে মনুষ্য সমাজে জিন-এর প্রভাবের চেয়েও মিম বেশী কার্য্যকরী ভূমিকা পালন করে এসেছে। বিশেষ করে কৃষিবিপ্লবের পর। যেমন: বহুগামিতা যা প্রাণীদের বৈশিষ্ট্য তা পরবর্ত্তীতে একগামীতে পরিণত হয় মানুষের সংস্কৃতি লালনের জন্য। পুরুষ বিয়ে না করে থাকে তাও জেনিটিক নয়। পুরুষ মিথ, পুরাণ, ট্যাবু তৈরি করে নারীর জন্য, ‘সতীত্ব’ শব্দের আড়ালে বন্দী রাখা— এসবই মিমেটিক।

তবে বহুগামিতার জিনটা প্রকাশ পায় যখন দাস বানিয়ে, উপপত্নী করে, কোটা পূরণ করে স্বর্গের ৭১টা হুর পরীর কাথা বা ‘বিবাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানের ছদ্মবেশে।

এই কাজগুলো যদিও আচরণটা মিমেটিক তবুও জেনেটিক প্রভাব।

ডকিন্স এভাবে মানব সভ্যতার বিকাশে জিন ও মিম এর প্রভাব এবং প্রাণীদের আচরণ, সমাজের বর্ব্বরতা, সংস্কার, কুসংস্কার, রিলেজিয়াস ফেনাটিসিজম, এমনকি বুদ্ধিভিত্তিক, সাংস্কৃতিক পরিবর্ত্তন, বিবর্ত্তনে এদের ভূমিকা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করেছেন এই বইয়ে। মানুষ সত্যিই এক অনন্য প্রজাতি। কয়েকটা বায়োলজিক্যাল ড্রাইভ-এ পরিচালিত হয় না। এর পিছনে অনেক অনুষঙ্গ কাজ করে।

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত সমালোচনা, দ্য সেলফিশ জিনি : রিচার্ড ডকিন্স

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *