হিজিবিজি আফটার আওয়ারসে মিনি ব্রেকফাষ্ট আড্ডা

তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মসয়ূদ মান্নান এসেছেন শীতকালীন অবকাশে তীব্র শীতের দেশ তুরস্ক থেকে অল্পশীতের দেশ বাংলাদেশে। তাকে উষ্ণ আমন্ত্রণ জানাতে আফটার আওয়ারসে মিনি ব্রেকফাষ্ট আড্ডার আয়োজন করলেন কবী ও ভ্রামণিক মাহমুদ হাফিজ যিনি এই তো সেদিন মান্যবর রাষ্ট্রদূতের ততোধিক উষ্ণ আতিথেয়তা পেয়েছেন কেবল ইস্তাম্বুল বা আঙ্কারায় নয়, গোটা তুরস্কে। গল্প হচ্ছিল সেই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দেশ নিয়েই, সুলতান সুলেমান টিভি সিরিজের সুবাদে যে দেশের প্রতি বাংলাদেশের পর্য্যটকদের আগ্রহ বাড়ছে সাথে যোগ হয়েছে তুরস্কের বিখ্যাত মসজিদগুলোর সুউচ্চ মিনার থেকে আজানধ্বনি শোনা। আধা-এশিয়ায় আধা-ইউরোপে গাত্রছড়ানো দেশটার প্রতি এদেশের লোকদের আকর্ষণের আরেক সূত্র ইসলাম, সুপক্ক ফলের মত টসটসে যুবতী আর বলিউডী সিনেমার নায়কদের মত যুবকেরা সে আকর্ষণের সলতে আরও উস্কে দিয়েছে। প্রধান সড়কটী বাদে বনানীর রাস্তাঘাটের সবগুলোই, নম্বরবিশিষ্ট। আর কী দৈব যোগাযোগ, প্রধান সড়কটী তুরস্কের জাতির জনক কামাল আতাতুর্কের নামেই। তা ওই প্রধান সড়ক আর তার সমান্তরাল ১১ নম্বর ছাড়া আর কোন্ সড়ককে নম্বর ধরে চিনি আমরা? এক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য গাইড হল গুগল মামা। সে দেখিয়ে দিল ১৮ নম্বর সড়ক কোন্‌টা আর কোন্দিকে। যাকে আমরা কবরস্থান রোড বলে চিনি সেটার নম্বর ২৭, আজই ম্যাপে দেখলাম। তার পেছনেই ১৮, আফটার লাইফের পরে আফটার আওয়ার। তা কে যেতে চায় ২৭-এ, যদিও ১৮ বা অন্যান্য জীবনের সড়কে যাওয়ার জন্য ওটার বিকল্প কমই আছে। ১৮ নম্বর সড়কটী বনানীকে বেঁধে রেখেছে গুলশানের সাথে, এক ধনী এলাকার হাত ধরে রেখেছে অন্য ধনী এলাকাকে। ‘এখানে সালেক থাকত,’ আজীবন প্রিয় বন্ধুদের ক্যারিয়ার কার্ভ অনুসরণ করা মসয়ূদ মান্নান বলল। তার স্মৃতিতে ১৮ নম্বর হল এক প্রশস্ত সড়ক, যেখানে সে বহুবার এসেছে। তবে এ হল পরের কথা।

আপাতত আমি আছি, আমিই প্রথম (অতিউৎসাহী হলে যা হয়), আফটার আওয়ার রেসিডেন্সীর সমুখে, বড়দিন উৎযাপনের অতিউৎসাহে যে সমুখের নীচু গুল্মগুলোকে সারারাত ধরে জ্বালিয়ে রেখেই ক্লান্ত হয়নি, প্রভাতে নেভাতে ভুলে গেছে। ক’ধাপ মার্বেলসাদা সিঁড়ী খাড়া উঠে গেছে, তার সমাপ্তিতে রিসেপসন কাউন্টার, রেসিডেন্সী হোটেলে নন-রেসিডেণ্ট অতিথি দেখে কৌতুহলী, পরে বুঝলেন এ তো সেই রাষ্ট্রদূতের পার্টী। হসপিটালিটী ইন্ডাস্ট্রী এমনিতেই অতিথিবান্ধব, অতিথি নারায়ণ ঐতিহ্যটী এরাই ধরে রেখেছে, প্রাইভেট রেসিডেন্সীতে সেবাপ্রদানের উৎসাহটী অত্যধিকই বলতে হবে। একজন যদি পথ দেখিয়ে চলে তো আরেকজন এসে দরজা মেলে ধরে। বামেই রেস্তোরাঁটী। তার দুপাশে দুটা কাচের দরোজার মাঝে অনুচ্চ ক্রিসমাস ট্রী ধরে রেখেছে সদ্যশেষ ক্রিসমাসের আমেজ। বড়দিনের বেলুনগুলো তখনো ছাদে ঝুলছে, চুপসে যায়নি, গোটা রেস্তোরাঁটা চার আসনের চৌকো টেবিলগুলো নিয়ে অতিথি অপেক্ষায় ডগোমগো। দূরে সার্ভিং ডিশগুলোর কৌমার্য্য যে অটুট তা বোঝা গেল তাদের কুমারী-সুলভ রূপালী দ্যুতিতে।

ঘুম যাকে আঁকড়ে ধরে রাখে বিছানায় সেই কবী আবদুর রব প্রথা ভেঙে এলেন আগে, আর যিনি ফজরের আজান কর্ণকুহরে পৌঁছানোর আগে তরাক করে লাফিয়ে উঠে বিছানা ছাড়েন সেই সৈয়দ আবু জাফর এলেন তার পরে। সঙ্গে মাহমুদ হাফিজ। একটু পরেই এলেন এলিজা বিনতে এলাহী। জাফর ভাই উঁকি দিয়ে দেখলেন আর মন্তব্য করলেন, বছরের ৩৬৫ দিনের ১৬৫ দিন এলিজা যার সাথে থাকে তিনি নামিয়ে দিয়ে গেলেন। তাহলে বাকী ২০০ দিন এলিজা কোথায় থাকে? এলিজা থাকে ভ্রমণে। কার সাথে থাকে? সে থাকে ঐতিহ্যের সাথে। হেরিটেজ ট্যুরিজমে এলিজা এক আলোচিত নাম। আবদুর রব সম্প্রতি ঘুরে এসেছেন মেহেরপুর। যশোরের মানুষ মেহেরপুরে গিয়ে মুগ্ধ। বললেন যশোরে যখন খেঁজুর চাষ বিলীয়মান, মেহেরপুরে তখন পরিকল্পিত ভাবে খেজুরের গাছ লাগানো হচ্ছে। আমঝুপী যাওয়ার রাস্তার দুপাশে লাগানো হয়েছে সারি সারি আম গাছ। আরেকটা বিষয় তার চোখে পড়েছে তা হল সীমান্ত সংলগ্ন ওই অঞ্চলে হেজাব আর বোরখার কম প্রতাপ। আমি বললাম, মৌলবাদীরা সারা বাংলাদেশকেই সৌদিপোষাকে ঢেকে দিতে গোপনে যে প্রচারণা চালিয়েছে তাতে বেশ সাফল্য পেয়েছে। অসাম্প্রদায়িক আর প্রগতিশীল লোকেরা তো হাত গুটিয়ে বসেছিল। এ শূন্যতায় ওয়াহাবী গোষ্ঠী তাদের পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণা ধর্ম্মভীরু মানুষের মগজে ঢুকিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে মানুষ এমনকি মৃত মা-বাবার ছবি দেয়াল থেকে নামিয়ে রেখেছে ছবি দেখা হারাম ফতোয়ার কারণে। এলিজা যখন ঢুকছিল তখন নাকি কথাসাহিত্যিক ফারুক মঈনউদ্দীন যাচ্ছিলেন ১৮ নম্বর সড়ক ধরে। তিনি বেরিয়েছেন মর্নিংওয়াকে। মাহমুদ হাফিজ তো তাকে কেডস আর ট্রাকস্যুটেই আনতে চান রেস্তোরাঁয়। এলিজাকে দেখে ফারুক মঈনউদ্দীন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি না সোনারচরে?’ আমি সে প্রশ্ন শুনিনি, আমিও জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি না সোনার চরে?’ ফেসবুকে পুরানো এক স্ট্যাটাস এই বিভ্রম বাঁধিয়েছিল। এলিজার পোষাক শীতকালের প্রতি ভ্রুক্ষেপহীন, তাই জোব্বাটোব্বা পরে আমি ও আবদুর রব যখন খুঁজছি আরও শীতলতা, এলিজা চাইল টেম্পারাচার বাড়াতে। সে ঠিকই ছিল, আমরা ভাবলাম শীত বাড়বে। এসির তাপমাত্রা নিয়ে এমন বিভ্রম অনেকেরই। যখন তারা বলে বাড়াও বাড়াও, তখন আসলে বলে, শীত বাড়াও।

এই মিনি ব্রেকফাষ্ট আড্ডায় যাদের যোগ দেওয়ার কথা মোটামুটি তারা এসে গেছেন, তবে তখনো আসেননি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটী, আজকের প্রধান অতিথি রাষ্ট্রদূত মহাশয়। দুই টেবিল জোড়া দিয়ে আমরা তার জন্য অপেক্ষা করি। তিনি এতটাই দীর্ঘদেহী যে কেবল পদাধিকারবলেই নয়, দৈহিক গড়নে ছাড়িয়ে যান বাকী সকলকে। হোটেলের লোকেরাও মুহূর্ত্তে বুঝে ফেলে ইনিই হলেন তিনি। শশব্যস্ত ছুঁটে আসেন তারা। রাষ্ট্রদূত আজ থ্রি পিস কাল সুটের ভেতর সাদা সার্টে ঝুলিয়েছেন বেগুনিরঙের দামী টাই আর কাঁধে ঝুলিয়েছেন মসৃণ সবুজ উত্তরীয়। সোনালী জরীর নক্সাদার তুর্কী টুপীতে তাকে তূরীয় রূপেই দেখা গেল। রাষ্ট্রদূত জোড়া দেওয়া টেবিলের হোষ্ট প্রান্তে গিয়ে আসন গ্রহণ করেন (বসেন বলা কি ঠিক হবে?), আমরা প্রাণ ফিরে পাই। মসয়ূদ মান্নান (আমার একান্ত বন্ধু বলে প্রতিবার মান্যবর বলছি না) বললেন, এখান থেকে তিনি ছুটবেন ঢাকা উত্তরের মেয়রের সাথে দেখা করতে। গুরুত্বপূর্ণ লোকদের সাথেই তাঁর ওঠাবসা, শুধু মাঝেমাঝে প্রাণের টানে ব্রেকফাষ্ট আড্ডায় যোগ দেন। মসয়ূদের অবলোকন হল ঢাকা খুব clumsy নগরীতে পরিণত হয়েছে, নান্দনিকতা থাকছে না।

প্রথমেই উঠে এল মাহমুদ হাফিজের মুখে অতুলনীয় তুরস্ক ভ্রমণের মিনি বৃত্তান্ত। তার ঝুলীতে এত গল্প জমে আছে যে তা বহুদিন লাগবে বলতে। তিনি এ নিয়ে লিখতে শুরু করেছেন। শুনে নড়েচড়ে বসলেন তুরস্কের রাষ্ট্রদূত আর তুরস্ক যেতে ব্যর্থ এক কবী। কী ভেবে শৈশবে মা-বাবা তার নাম রেখেছিলেন রুমী। মাহমুদ হাফিজ আজ আমাদের যে জালালুদ্দিন রুমীর কাহিনী শোনাবেন, গোটা তুরস্ক বুঁদ হয়ে আছে তাঁর চরণে!

পরবর্ত্তী সময়ে মাহমুদ হাফিজ তার তুরস্কঝাঁপী খুলে এক এক করে বের করে আনলেন আনাতোলিয়া, কাপাদোকিয়া, গাজিআন্তেপ, আফিয়ন, কোনিয়া নামের কবুতরসমূহ— কোনটী ঝুঁটীঅলা, কোনটী বাহারী পাখাঅলা, কোনটি শুধুই বাকবাকুম। আনাতোলিয়া এশিয়া মাইনরের প্রাচীন রাষ্ট্র আর কোনিয়া হল সেলজুকদের প্রাচীন রাজধানী। সেলজুকরা এসেছিল তুর্কেমেনিস্তান থেকে। এই যোদ্ধাজাতি জয় করে নিয়েছিল এশিয়া মাইনর ও মধ্য এশিয়ার বিরাট ভূভাগ। কাপাদোকিয়ায় পাহাড়ের ভেতর গুহা নয়, আবিস্কৃত হয়েছে পাথুরে বাড়ী। প্রত্নতাত্ত্বিক ( তুর্কিরা বলে তেপে) খনন চলছে। আমরা তো শৈশবে পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি নীল নদের তীরে গড়ে ওঠা ৫০০০ বছরের পুরানো মিশরীয় সভ্যতাই সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা। তুরস্কে পাওয়া যাচ্ছে সাড়ে সাত হাজার বছরের পুরানো সভ্যতা। নতুন কিছু জায়গায় খোঁড়াখুড়িতে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ অনুমান করছেন তুরস্কে সভ্যতার গোড়াপত্তন হয় ১২ হাজার বছর আগে। সভ্যতার শুরু নগর থেকেই আর সে শুরুটা হয়েছিল তুরস্ক থেকে। একথা শুনে ঐতিহ্যসন্ধানী এলিজা বলল, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন নগরী হল সিরিয়ার রাজধানী জর্ডান। হায়, আমার তৎক্ষণাৎ মনে পড়ল পৃথিবীর সবচেয়ে অবসবাসযোগ্য নগরীও ওই জর্ডানই (এমনকি সে টেক্কা দিয়েছে ঢাকাকেও)। পৃথিবীর মানুষ কতটা ঐতিহ্যপ্রিয়, তা বোঝা যায় এই একটা উদাহরণে, পূর্ব্বপুরুষের রেখে যাওয়া স্বর্গকে আমরা নরক বানিয়ে রেখেছি।

মাহমুদ হাফিজ তুরস্কের গল্প বলেন আর রাষ্ট্রদূত অল্প অল্প মাথা নেড়ে তার অনুমোদন দেন। কোথাও কিছু বাদ পড়লে জুড়ে দেন। মাহমুদ হাফিজ বললেন বুকের ভেতর বাড়িঘর নিয়ে ঘুমন্তসজাগ পাহাড়গুলো বেয়ে ওপরে ওঠেন না বেশীরভাগ পর্য্যটক, তারা নীচ থেক ছবি-টবি তুলে ফিরে আসেন আর নাতি-নাতনিদের দেখান, দেখ, আমি কোথায় গিয়েছিলাম, একবারে সভ্যতার মর্ম্মমূলে। জানি না এডমন্ড হিলারী কোন অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন কি না, মাহমুদ হাফিজ কিন্তু কিছু পুরানো হাড়ের ওপর ভরসা করেই উঠে গিয়েছিলেন হিমালয়ের বামনভাই বলাও ঠিক হবে না, হতে পারে টিলাদের রাজা, সেই কাপাদোকিয়া পাহাড়ের চূড়ায়, আর চতুর্পার্শ্বে তাকিয়ে দেখেছিলেন গলায় মেডেল পরানোর কেউ নেই, কেবল নীচের দৃশ্য মেডেল হয়ে ঝুলছে। পর্য্যটকরা কাপাদোকিয়ায় যায় আরেক আকর্ষণে। তা হল বেলুনে চড়ে আকাশে ভ্রমণ। দুনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত বেলুন-ওড়া ভূমী হল এই কাপাদোকিয়া। জানিনা মাহমুদ হাফিজের বেলুনে চড়ে আটলাণ্টিক মহাসাগর পাড়ি দেওয়া তিন বন্ধু বেন আবরুজ্জু, ম্যাক্সি এনডারসন ও ল্যারি নিউম্যানের অনুসারী হতে সাধ হয়েছিল কি না!

তার গল্পঝুলীর পরবর্ত্তী পায়রা গাজিআান্তেপ। অঞ্চলটার আসল নাম আন্তেপ। ওই সেলজুকদের মতই এখানকার লোকেরাও সাহসী, যুদ্ধবিগ্রহে পটু। সড়কী ও বল্লম, ঢাল ও তলোয়ারের যুগে, ঘোড়াদের বশ মানিয়ে এরা হয়ে ওঠেছিল যুদ্ধজয়ী অর্থাৎ গাজী। সেই থেকে নাম গাজী আন্তেপ। বিখ্যাত সিল্ক রুটের ওপর এই নগরী, একসময় ছিল সিল্ক রুটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগরী। আফিয়ান প্রদেশে গিয়ে হল ভিন্ন অভিজ্ঞতা। সেখানে ট্যাক্সিচালক টিপস নেয় না, তার হাতে রোলেক্স ঘড়ী। ব্যাপার কী? আফিয়ানে সবাই ধনী, মাহমুদ হাফিজের মতে, বিলিওয়নার। সেখানে যে NG হোটেলে তারা রাত কাটিয়েছিলেন তা ছিল প্রকাণ্ড ও গর্জিয়াস। ডাইনিং হল্টা এত বড় যে তার ভেতরে গাড়ী নিয়ে লোকেরা ঢোকে, লনে যত লোক বসে আছে, তাদের বেশভূষা, চেহারা দেখে বোঝা যায় এরা প্রচণ্ড ধনী। একসময় আফিমের ব্যবসা ছিল আফিয়ানে (আফিম থেকেই আফিয়ান), আফিমঐতিহ্য থেকেই নগরবাসী ধনী (স্বর্ণের নগরী জোহানসবার্গে কিন্তু সকলে ধনী নয়)।

মসয়ূদ মান্নান সংস্কৃতিপ্রিয় শুধু নন, ইতিহাস-ভূগোল প্রিয়। ৩৬ বছরের পেশাগত জীবনে দেখেছেন পৃথিবীর অনেক দেশ, সেসব ভূগোলে তার পা পড়েছে, আগ্রহ নিয়ে জেনেছেন কৃষ্টি ও ইতিহাস। তিনি বললেন নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যে অপরূপ বদরুমের কথা যে বদরুম দেখতে এসেছিলেন আমাদের ব্যাচের চিকিৎসক সহপাঠিনী ডা. রেয়ান আনিস। ইস্তাম্বুল নেমে মসয়ূদ মান্নানকে ফোন দিয়ে জানিয়েছিল ৮১ প্রদেশের বিস্তৃত দেশ তুরস্কের আর কোথাও নয়, স্বামী ও পুত্রসহ সে যাবে বদরুম। ‘রেয়ান আনিসের কথা তোমার মনে আছে, কামরুল?’ মসয়ূদ মান্নানের প্রশ্ন। আমি বলি, আমাদের ব্যাচের, শুধু আমাদের ব্যাচ কেন, গোটা মেডিকেল কলেজের, সেরা সুন্দরীকে কেউ কি ভোলে?’ একথা শুনে বাকীদের চিত্তে চাঞ্চল্য দেখা গেল। তারপর? তারপর?? তাদের কোরাসকৌতুহল! তারপর আর কী? আমাদের ব্যাচ, শুধু আমাদের ব্যাচ কেন, গোটা মেডিকেল কলেজ তার প্রেমে পড়ে গেল। মসয়ূদ মৃদু তিরস্কার করে আমাকে বললেন, ‘তোমার পাগলামি আর গেল না।’

মাহমুদ হাফিজ ঘোরেন বেশী, লেখেন কম। লেখালেখির ব্যাপারে তার ছুঁচিবাই রয়েছে। লেখায় পারফেকশন চান তিনি। একবার বললেন, অনেকে একশ বই লিখেছে, আমি হয়ত একটা লিখেছি, তুলাদণ্ডে আমরা কিন্তু এক জায়গাতেই আছি। আমি বল্লাম, এক জায়গাতে নেই। এটা ভুল ধারণা। বিপুল রচনার অধ্যবসায়কে খাট করা যায় না। যে লেখেনি তার লেখার ক্ষমতা প্রশ্নসাপেক্ষ! আমার ওই গজআক্রমণকে ঘোড়া দিয়ে টপকে গেলেন মাহমুদ হাফিজ এই বলে যে ওই একটা লেখা যদি মাস্টারপিস হয়? এর আগে জীবন সাফল্যের পরিমাপ করছিলেন রাষ্ট্রদূত স্বয়ং। তার মতে সফল সেই যে সবদিকে ভারসাম্য রেখে চলতে পারে। ভারসাম্য রক্ষার একটা নমুনা হল বিয়ে ও সংসার টিকিয়ে রাখতে পারার সক্ষমতা, সুখী হওয়া। সে কিছু মানুষের উদাহরণ দিল যারা কর্ম্মক্ষেত্রে সফল, আবার পারিবারিক জীবনেও সফল। আমি বললাম, অনেক প্রতিভাবান মানুষ পারিবারিক জীবনে সুখী ছিলেন না, যেমন লিউ টলষ্টয়, যেমন আইনস্টাইন ( তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে অবশ্য সুখের ছিল), এরকম ভুরিভুরি উদাহরণ আছে।

ব্রেকফাষ্ট আড্ডার বন্ধুদের জন্য মসয়ূদ মান্নান এক বাক্স চকলেট এনেছেন। সবার কৌতুহল সেটা টার্কিশ ডিলাইট কি না? মসয়ূদ বললেন, ওটা টার্কিশ ডিলাইট থেকে মজাদার। বুঝলাম সকল ডিলাইট যারা ব্রান্ডিং করে সেই বড় বড় চকলেট কোম্পানীর একটা। কথায় মজেছিলাম আমরা, হঠাৎ দেখি এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকা সৈয়দ আবু জাফর চকলেটের প্যাকেটের ফিতা খুলছেন আর বলছেন, “আপনারা তর্ক চালিয়ে যান, আমি শুনছি।” আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল বাঙালীর হাসির গল্পের দুইবন্ধুর সেই কাঁঠাল খাওয়ার কাহিনী আর তার সমাপ্তিবাক্য ‘আমার বাবা পড়ল আর মরল।’

এসেছি ব্রেকফাষ্ট করতে অথচ বিবরণী-ভরা শুধু কথামালা, খাবার নেই। এই যে ছয় অতিথিকে সার্ভ করতে তিন পরিবেশক ডাইনিং স্পেসে উন্মুখ হয়ে ঘুরছে, তাদের তদারকি করছেন একজন ম্যানেজার, কিচেনের বাইরেই চারজন, কিচেনে কজন আছেন কে জানে, দুজন হলে তো ছয় অতিথির জন্য ছয় পরিবেশক— এরা ভাবছে এই অতিথিরা কি চকলেট খেয়েই ব্রেকফাষ্ট সারবে নাকি রূপালী শানকীর নীচে রাখা প্রাতরাশ কিছু খাবে? পূবের দেয়াল ঘেষে রাখা ছয় (আবার ছয়?) সার্ভিং ডিশগুলোর রূপারঙ কাছিম পিঠের ঢাকনার নীচে চানা মশলা, চিকেন কিমা, পাস্তা উইথ চিকেন, ক্লাব স্যান্ডউইচ, সসেজ মাশরুম ও মেয়োনেজে মাখা চিকেন সালাদ। বড়লোকের সব খাবারের পাশে গরীবের আটার রুটীও আছে, পরাক্রমশালী পরোটা হটিয়ে যে এখন আভিজাত্য পেতে তৎপর। আমরা সেদিকে যাই না, আমরা যাই দখিন দেয়ালে যেখানে দুই কাচের জারে দুপ্রকার ফল— তরমুজ ও পেঁপের রস— খাটো কাচের গ্লাসে ভরে নিই। ফ্রুট জুস শেষ করে যাই কোণায় পেটমোটা কাল কলসীতে রাখা বাহারী নামের ক্রিম অব মাশরুম স্যূপ সাদা বাটী ভরে আনতে। এখানে ব্রেকফাষ্ট খেতে হয় ধাপে ধাপে। এরপরে ওই ছয় রূপালী ডিশের বন্দনা, বড় প্লেট বাগিয়ে ধরে বন্দরে বন্দরে তরী ভেড়ানো, চকচকে সুন্দরীরা কে কী লুকিয়ে রেখেছে তা ঘোমটা খুলে দেখা আর অল্প অল্প প্লেটে তোলা। কিচেন থেকে আসছে ডিম পোচ ও ওমলেট। খাবার জমে উঠল সঙ্গে ওই আলাপন, কখনো কিছুটা তর্ক-বিতর্ক, তবে সবই মধুর।

খাবার দেখে মাহমুদ হাফিজের মনে পড়ল তুরস্কের বিখ্যাত কাবাবের কথা। টার্কিশ কাবাবের নাম দুনিয়াজোড়া। কাপাদোকিয়াতে হাফিজ দম্পতির সাথে আঙ্কারা থেকে যোগ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রদূত, সেখানে বিরাট প্লেট ভরে কাবাব এলো। মাহমুদ হাফিজ ও জুলেখা ফেরদৌসী কাবাব খেয়ে তৃপ্ত, ভাবলেন আহারের পাট বুঝি শেষ। তখনি জানলেন ওগুলো ছিল এপিটাইজার, মেইন ডিশ তখনো বাকী! তারা তো অবাক, বলে কী, আরও খেতে হবে? মেইন ডিশ শেষে আবার ডেজার্টের বিবিধ পদ। খাবারের উদ্যান আর পানীয়ের নহর বইছে। কে বলবে পাশের দেশ সিরিয়ার উদ্বাস্তুশিবিরে না খেতে পেয়ে মারা পড়ছে শিশুরা। বিবরণ শুনে বুঝতে পারলাম দ্য গ্রেট কাবাব ফ্যাক্টরী এই তুর্কী আপ্যায়ন রীতিটিই অনুসরণ করে, রেস্তোরাঁ চেইনটী যদিও ভারতীয়।

ঐ খাওয়া-দাওয়ার মাঝখানে আমাদের তুমুল আড্ডা চলল। তুরস্ক যখন সেন্টারপিস, তখন ওরহান পামুক আসবেই, তুরস্কের একমাত্র সাহিত্যে নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক। তিনি যদিও বাস করেন প্যারিসে, ইস্তাম্বুলের নাসানতাসিতে পামুক এপার্টমেণ্ট দেখতে ভীড় জমায় পর্য্যটকরা। এলিজা বিনতে এলাহী কিন্তু পামুকের লেখার বাংলা অনুবাদ পড়ে রীতিমত হতাশ, নোবেল বিজয়ী মানের মনে হয়নি। তা হতে পারে অনুবাদের দুর্ব্বলতা, তবে আলোচনায় যা উঠে এল তা হল নাজিম হিকমতের মত শক্তিশালী কবীকে না দিয়ে ওরহান পামুককে নোবেল প্রাইজ দেওয়ার ভেতর রাজনীতি আছে। এই রাজনীতি হল আর্মেনিয়ান গণহত্যা নিয়ে তুরস্ক চুপচাপ বা পাশ কাটিয়ে যেতে চায়, কিন্তু পামুকের লেখায় স্বীকারোক্তি রয়েছে, রয়েছে দায়স্বীকার, পশ্চিমী কর্ত্তারা যা পছন্দ করে।

প্রাতরাশের প্রধান পানীয় হল চা। এখানে কফিও আছে। আমরা বার তিনেক কখনো চা, কখনো কফি পান করি। মসয়ূদ হঠাৎ প্রশ্ন করল আমাদের ব্যাচে (৯৯ এইচএসসি) বাংলায় সবচেয়ে মেধাবী কে? সে শৈশব ও কৈশোরে বাংলার তিন মহারথী ড. আনিসুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের স্নেহআদর পেয়েছে। তার দুঃখময় উক্তি ‘কামরুল (আমি) যদি বাংলায় পড়ত তবে আরেকজন মনিরুজ্জামান হতে পারত।’ ‘আমাদের ব্যাচে বাংলা সাহিত্যে ব্রিলিয়াণ্ট কেউ নেই’— এ উপপাদ্যের সিদ্ধান্ত টানল এই বলে যে বাংলায় আমাদের ব্যাচের সেরা ছাত্র হল ড. রফিকুল্লাহ খান। আমি বাংলার ছাত্র নই, আমি আর কী বলি?

আমরা খাচ্ছি এমনি সময়ে ফায়ার এলার্ম বেজে ওঠল, সে কি চুলার ধোঁয়ায় নাকি কথার ধোঁয়ায় বোঝা গেল না। আবদুর রব মসয়ূদ মান্নানের কথার সমর্থনে বললেন, গোছালো হলে সাফল্য বেশী হয়। আমি বললাম, প্রতিভাবানরা বেশী গোছালো হয় না। তারা সিষ্টেম মেনে চলে না, তাদের মাঝে আমলাতান্ত্রিক আচরণও নেই। বস্তুত সাফল্যের সংজ্ঞা নির্দ্ধারণে আমাদের মাঝে মতভেদ দেখা দিল। নীচের উক্তিগুলো তাই প্রমাণ করে।

মসয়ূদ মান্নান: সাফল্য হল সবকূলের ভারসাম্য মিলিয়ে যা আসে। সাফল্য অর্জ্জন খুব কঠিন।

আবদুর রব: সাফল্য লাভ করতে সিষ্টেমেটিক হতে হয়।

মাহমুদ হাফিজ: সাফল্য জিনিষটী আপেক্ষিক।

কামরুল হাসান: সাফল্যের বিভিন্ন সংজ্ঞা ও বহুবিধ মাত্রা আছে।

তুর্কী খাবারে মত আফটার আওয়ারের ব্রেকফাষ্টেও ডেজার্ট আছে। তিন প্রকার ফল— কলা, পেয়ারা ও আপেল আর ছিল পুডিং। আমরা মরুভূমীর দিকে যাচ্ছি না দেখে পরিবেশকরা সেসব তুলে নিয়েছিল, এখন জায়গা শূন্য দেখে মন মোচড় দিয়ে ওঠল, আর প্রায় আর্ত্তনাদের মত শোনাল কথাটা, ‘আমি পুডিং খাব’। আর কে খাবে? হাত তুলল আরও দুজন। এবার পুডিং এল কিচেন থেকে। রাষ্ট্রদূতের জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম ‘হায়দ্রাবাদের যাত্রী’ ও ‘Selected Poems’। মাহমুদ হাফিজ দিলেন ভ্রমণগদ্যের দুটি সংখ্যা; আবদুর রব দিলেন The Dhaka Literature পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটী।

দুজন সিনিয়র কবীর কবিতাগ্রন্থ নিয়ে আমার দুটা সাম্প্রতিক লেখার চালচিত্র বলতেই এলিজার সুচিন্তিত মন্তব্য হল, বুঝেছি কাব্যোলোচনা নয়, সম্পাদকগণ চান মানপত্রজাতীয় লেখা, যা ভরে থাকবে প্রশংসায়। সমালোচনা সইতে পারেন না আমাদের কবী-লেখকরা, সমালোচনায় তারা আহত হন। এলিজা বললেন, বুঝলাম এ হল বিজনেস। তাকে এণ্টারপ্রাইজ বলে নরম করতে চাইলেন আবদুর রব। মসয়ূদ মান্নান জানালেন ৮১ প্রদেশ আর ২০০ বড় শহরের দেশ তুরস্ক অতুলনীয় সৌন্দর্য্যের অধিকারী। সেখানে বারবার যাওয়া যায়। তুরস্কে এত কিছু দেখার আছে যে তৃষ্ণা মেটে না। তবে বিদেশ যতই সুন্দর হোক, জীবন সেখানে যান্ত্রিক। দেশে এমন কোন আড্ডায়, যেখানে প্রাণখুলে কথা বলা যায়, সেখানে আসতে ভাল লাগে তার। আমাকে নিয়েই তার ভয়— কী লিখতে গিয়ে কী লিখে ফেলি।

ফিরে আসার প্রাক্কালে আফটার আওয়ার থেকে একটা কলম উপহার পেলাম। আমি যে লিখছিলাম তা বোধকরি এদের নজরে পড়েছিল। রাষ্ট্রদুত কিছু না লিখেও কলম পেলেন বোধকরি তিনি যে এসেছেন, পদধূলি রেখেছেন- সেই আনন্দ স্মরনীয় করে রাখার জন্য।

মসয়ূদ চলে গেল মেয়রের অফিসে, রব ভাই তার গাড়ীতে আদাবর, রইল বাকী আমিসহ চারজন আমার ভাঙা নায়ে। এলিজা বলল, নৌকা পুরানো হলেও মাঝীটা ভাল। ভাটিয়ালী গান (পড়তে হবে কবিতা) গাইতে গাইতে নৌকা চালান। এমন নৌকা ডোবে কম। কিন্তু ঝড় এলে?

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত হিজিবিজি, আফটার আওয়ারসে মিনি ব্রেকফাষ্ট আড্ডা — তে সম্পাদিত।

১ Comment

  1. আফটার আওয়ারসে মিনি ব্রেকফাস্ট আড্ডার চমৎকার সরেশ বর্ণনা পরে যারপরনেই আপ্লুত হলাম! আহা, এমন ডিটেইলস বর্ণনা কামরুল হাসান ছাড়া আর কোথায় গেলে পাই। লেখককে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই। ভ্রমণসাহিত্যের জগতে ব্রেকফাস্ট আড্ডা এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। লেখাটি প্রকাশের জন্য ‘প্রকৃতিপুরুষ’ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *