ভাষাতত্ত্ব আর সমাজ মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণে দেখা যায় যে বাংলার জনগণ সবসময় আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা চেতনা নিয়েই বিচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে গেছে। উনবিংশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁ তথাকথিত বাঙালী ভদ্রলোক সমাজের জন্য কিছুটা কাজে আসলেও, নিম্নবর্গের অচ্ছুৎ হিন্দু আর মুসলমান বাঙালী জনগোষ্ঠীর জন্য কোন কাজেই আসেনি। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী তাদের আত্মপরিচয় নিয়েও বিভ্রান্ত, তারা বুঝতে পারছে না তাদের আসল পরিচয় কী হবে। মুসলমান, বাঙালী, বাঙাল, মুসলমান বাঙালী এবং বাঙালী মুসলমান শব্দগুলো কখনো এককভাবে আবার কখনো যুগ্ম-বৈপরীত্য সৃষ্টি করে বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর মন তোলপাড় করছে। পশ্চিমবঙ্গের জনগোষ্ঠীর অবস্থাও খুব ভাল না, তারা ‘বাঙালী’ আর ‘ভারতীয়’ শব্দ যুগল নিয়ে যুগ্ম-বৈপরীত্য তৈরি করে ভীষণভাবে বিভ্রান্ত। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীরা ‘সর্ব্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের’ কাছে আত্মসমর্পণ করে বাংলা ভাষাকেও যথাযোগ্য মর্য্যাদা দিচ্ছে না, তারা দৈনন্দিন কাজে ব্যাবহার করছে ইংরেজী আর হিন্দীর সাথে বাংলা মেশানো ‘হিন্দিং’ ভাষা।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীদের যৌথ-অচেতনে যে জাত-পাত, ধর্ম্ম, আঞ্চলিকতা ও অর্থনৈতিক বৈষম্য-জনিত হীনমন্যতা, স্বার্থপরতা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি ঐতিহাসিক কারণে বিবর্ত্তনের উপাদান হিসেবে জমা হয়ে গেছে, সেগুলোকে দূর করে শুধুমাত্র বাঙালী হিসেবে গর্বের সাথে এগিয়ে যাওয়াটাই উচিৎ হবে। তবে বাঙালীর যৌথ-মনস্তত্ত্বকে রোগমুক্ত করার জন্য প্রয়োজন হবে ভাষা ভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদী সোশাল সাইকোথেরাপির।
আমার লেখাটা ভাষাতত্ত্ব আর যৌথ-মনস্তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে লেখা। যৌথ মনস্তত্ত্ব নিয়ে জানতে হলে মনস্তত্ত্ববিদ ও দার্শনিক কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং এবং জাক লাকা’র তত্ত্ব ও দর্শন সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকলে ভাল হয়। ভাষাতত্ত্ব নিয়ে প্রাথমিক ধারণার জন্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাংলা ভাষাতত্ত্বের ভুমিকা’ শিরোনামের বইটি দেখা যেতে পারে। যদি উল্লেখিত তত্ত্ব বা দর্শনের কোন বই না পাওয়া যায়, তবে ইন্টারনেট ঘেঁটে এ সম্পর্কে জানা যাবে।
বাংলাদেশের মানুষ সহজ সরল বটে, কিন্তু ঐতিহাসিক কারণে বাঙালীর সমাজ কাঠামোর উঁচু থেকে নিচু পর্য্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বার্থপর, মিথ্যাচারী, সাম্প্রদায়িক এবং পরশ্রীকাতর। গ্রামের একজন সাধারণ কৃষক চিন্তা করে কী ভাবে তার ভাইকে ঠকানো যায়, কি ভাবে বর্গা চাষের ধান কমবেশী করা যায়, একজন দোকানদার চিন্তা করে কী করে ওজনে কম দেয়া যায়, মেম্বার সাহেব চিন্তা করেন কী ভাবে রিলিফের গম চুরি করা যায় এবং এ ভাবে চুরি বিষয়ক কর্ম্মকান্ড সরকারের ওপরিতল পর্য্যন্ত পৌছায়। স্বার্থপরতা, মিত্থাচারিতা আর পরশ্রীকাতরতার বিষয় প্রতিদিনের খবরের কাগজ পরলেই বোঝা যাবে।
মানুষের মন যেহেতু ভাষ সংগঠনে তৈরী, সেহেতু ভাষার বিবর্ত্তন মানুষের চরিত্রে সরাসরি প্রভাব রাখে। বিভিন্ন ধর্ম্মগ্রন্থ, পুরাণের বাণী এবং মোঘল, পাঠান, তুর্কী আর ইংরেজী বয়ান আমাদের মনস্তাত্ত্বিক বিবর্ত্তণ ইতোমধ্যেই ঘটিয়ে দিয়েছে। বর্ত্তমানেও আঞ্চলিক রাজনৈতিক কারণে আমরা বাঙালীরা যদি হিন্দী Cultural Imperialism-এর শিকার হই, তবে আমাদের আগামী প্রজন্ম আমাদের অপদার্থ বলবে।
সমাজের প্রতিটি স্তরে যদি যথাযোগ্য নেতা আসে, এবং সে যদি তার সম্মোহনী ভাষায় মানুষকে প্রগতিশীল করে তোলে, তবে তাকেই আমরা বলব ভাষাভিত্তিক সোশ্যাল সাইকোথেরাপি। ভাষাভিত্তিক সোশ্যাল সাইকোথেরাপি ইচ্ছে করলে আমাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মিডিয়াও দিতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের যা আছে, সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়েই আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের সাহিত্য, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি আমাদের সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক অনুপ্রেরণা। আমাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উত্তরণের জন্য রোম বা চীনে যেতে হবে না, আমাদের প্রয়োজন নেই কার্ল মার্ক্সের দর্শনের পতনের কারণ সমুহ বিশ্লেষণ করার।
মঈন চৌধুরী রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত সমসাময়িক, বাঙালীর চিন্তা