
জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা নিয়ে আমরা আমাদের ভাষার সমাজে আছি, কিন্তু ভাষা জানা আর প্রকাশের যোগ্যতা আমাদের এক রকম নয়। ভাষাবিজ্ঞানী জোনাথান কালার ‘কিছু বোঝা আর না বোঝার’ সাথে ভাষা বিষয়ক Competence আর Performance-কে যুক্ত করে বলেন, একই বিষয় সম্পর্কে আমরা ভিন্ন মাত্রার ব্যখ্যা বিশ্লেষণ উপস্থিত করতে পারি শুধুমাত্র ভাষা প্রয়োগের কারণে। জাক দেরিদার Deconstruction বা বিনির্ম্মানের দর্শনেও আমার ভাষার এই সত্যকে খুঁজে পাই।
আমাদের সত্তার সাথে ভাষা যুক্ত থাকার কারনে, আমাদের জীবন ও জগৎ বিষয়ক ধ্যান ধারণাও ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার রূপ ধারণ করে। তবে জীবন ও জগৎ নিয়ে কিছু কিছু ধারণা আমাদের একই মাত্রায় থাকে, যার ফলে সমাজে আমরা একই সাথে চলতে পারি। মনস্তত্ত্ববিদ কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং মানুষের যৌথ মনস্তত্তের কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে জগৎ ও জীবন সম্পর্কীয় কিছু স্বতঃসিদ্ধ ধারণা মানুষের মনে যৌথভাবে অবস্থান করে। এমন যৌথ মনস্তত্ত্ব না থাকলে আমরা সামাজিক মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করতে পারতাম না। এখানে উল্লেখযোগ্য যে আমাদের যৌথ মনস্তত্ত্বই তৈরী করেছে আমাদের সার্ব্বিক চেতনাকাঠামো বা প্যারাডাইম।
আমাদের মুল সমস্যাই হল আমাদের প্যারাডাইম বা চেতনাকাঠামো। একই যৌথ-মনস্ততত্ত্বে, একই প্যারাডাইমে আমাদের ইতিহাসে ছিল জাতপাত, কুলীন-অচ্ছুত, ম্লেচ্ছ-মালাউন, শোষক-শোষিত ইত্যাদির মত বিভাজন। বর্ত্তমানে আছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-চেতনাহীনতা, প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতিক্রিয়াশীল প্রগতিশীল-প্রগতিশীল প্রগতিশীল, ছুপা-প্রগতিশীল, রাজাকার-নব্যরাজাকার, প্রগতিশীল মৌলবাদী-প্রতিক্রিয়াশীলমৌলবাদী ইত্যাদির মত বিভাজন। ভাষাভিত্তিক এই বিভাজনগুলোর প্রেক্ষাপটে আছে সত্য-অসত্য। প্রগতিকে রক্ষা করতে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল মাস্তান বাহিনী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিক্রি করে চালু হয়েছে ঘুষ, খুন, লুটপাট আর অরাজনৈতিক কর্ম্মকাণ্ড। সব ধরণের প্যারাডাইমিক ঘটনাকে জায়েজ করার জন্য চালু আছে ভাষাভিত্তিক পণ্ডিতদের বক্তব্য, বিবৃতি, বক্তৃতা আর টকশো। ভাষাচক্রে মানুষ হচ্ছে বিভ্রান্ত, বিচলিত, অবদমিত, আর মানুষ নিস্তেজ হয়ে চুপ করে গ্রহণ করছে সব।
আমাদের এগুতে হলে আমাদের চেতনাকাঠামোকে বদলাতে হবে। কিন্ত বদলাব কী ভাবে? প্রতিদিনের বিনোদনমূলক টকশো, ২৫০ জনের মানববন্ধন, বিবৃতি আর সংবাদ সম্মেলন দিয়ে হবে না। আপনারা দেখুন তাবলীগ জামাতকে, তারা ধর্ম্মপ্রচারের জন্য দলে দলে চিল্লায় যায়, তারা বছরে একবার ২০ লক্ষ লোকের জামাত করে টঙ্গীতে। সারা বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মসজিদে প্রতিবছর ওয়াজ মাহফীল হয়। আর আপনারা বড় বড় মহৎ প্রগতির কথা যারা বলেন, তারা কি প্রগতির চিল্লায় যান? আপনারা কী প্রগতির ওয়াজ মাহফীল করেন? মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা, অসাম্প্রদায়িকতার কথা, দুর্নীতিমুক্ত হবার কথা আর ভাল মানুষ হতে বলেন? নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু আপনারা বলেন বলে মনে হয় না। আমাদের ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া আর খবরের কাগজ আছে টাকা বানানো আর দালালীর পেছনে। মানুষের চেতনাকাঠামো বা প্যারাডাইম বদলানোর কথা বলতে তারাও নারাজ।
আথচ মানুষের যৌথ মনস্তত্ত্ব বা চেতনায় ব্যাপক পরিবর্ত্তন আনার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী প্রচার অভিযান। আমাদের ভাষা আছে, আমরা কী তার ব্যাবহার করতে পারি না? যদি পণ্ডিতগন মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতি জেনে থাকেন, তবে সোসাল সাইকোথেরাপি বুঝবেন না কেন? আগামিকাল থেকে চেতনা পরিবর্ত্তনের প্রচার শুরু করুন, দুই বছরে ফল পাবেন।
লেখক একজন সামান্যজন, দেশের পণ্ডিতজন সহ সরকারের কাওকে চেনে না। লেখাটি লেখা হয়েছে পাঠকের জন্য। তবে পাঠকরা যদি মহামানবদের সাথে পরিচিত থাকেন, তবে এই কথাগুলো পৌঁছে দেবেন।
মঈন চৌধুরী রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত সমসাময়িক, ভাষার সমাজ, চেতনাকাঠামো ও পরিবর্ত্তন