গদ্য মানবশরীর ও বর্ণমালা

এই নিবন্ধে বাংলা বর্ণমালার বর্ণের আলোয় মানুষের শরীরে বিভিন্ন অংশ এবং জীবনদর্শনের আলোচনা করার চেষ্টা করব। শরীরের প্রতিটী অংশের নাম তার কর্ম্মানুসারে হয়। প্রথমে মাথা দিয়ে কথা শুরু করি। মাথা শব্দে ম বর্ণে সীমায়ন, থ বর্ণে থাকন, আ বর্ণে আধার বুঝা চলে। মা (সীমায়িতকরণের আধার) থাকে যে আধারে তাকে মাথা বলে। মাথার ভিতরে আছে মস্তিষ্ক (brain) যা জগতের প্রতিটী ক্রিয়া এবং ক্রিয়াকারীকে সীমায়িত বা পরিমাপ করার উপায় (ম = সীমায়ন, পরিমাপ)। মস্তিষ্কে মনন ক্রিয়া হয়। মন সবকিছু পরিমাপ করে বলেই তাকে মন বলে। মন শব্দে ম বর্ণে মিতকরণ এবং ন বর্ণে on-করণ বুঝতে হবে।

মাথার দুপাশে দুটী কর্ণ আছে। কর্ ও ণ জুড়ে কর্ণ হয়, এখানে কর্ মানে করা এবং ণ মানে ‘টঙ্কারণরহস্য’। চারপাশে ঘটে চলা বিভিন্ন ক্রিয়ার (কর্-এর) ফলে উৎপন্ন শব্দ কর্ণে গিয়ে টঙ্কারিত (ণ) হয়, তাই তাকে কর্ণ বলে। কর্ণ রাজার মতোই, দেহের কর্ণধার। সমস্ত কথা রাজসমীপে শুনানির জন্য নীত হয়। কর্ণ ভারসাম্য রক্ষাতেও সাহায্য করে।

মাথা সব করে বলে তাকে ক বলা চলে। বাংলা ক বর্ণের অর্থ ‘করে যে’, আর একটী অর্থ মাথা। ক বা মাথাকে যা পালন করে তাই কপাল। কপাল মানে ‘শিরোরক্ষক’, এটী ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ। তবে কারও মাথা কাজ না করলে বা বন্ধ হয়ে গেলে সে কবন্ধ (মুণ্ডহীন ধড়) হয়ে যায়।

ক বা মাথা যাকে চয়ন করে রাখে তাকে বলব কচ বা চুল। কচ শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ হল ‘যাহা মস্তকে ধারণ করা হয়’। কচ শব্দের চ বর্ণে চয়ন ক্রিয়া বুঝতে হয়। ক বা মাথাকে যা আবরণ করে তাকে কবরী (খোঁপা) বলতে পারি।

কপালের দুপাশে আছে রগ, সেখানে আছে রগের শিরা ও ধমনী (superficial temporal vessels)। রাগী লোকে রেগে গেলে তাদের রগে রক্তের বেগ বেড়ে যায়। কেউ রেগে গেলে তার রগ দাপাদাপি করে। রাগ শব্দটী রগ থেকে জাত (যেমন দাশরথি মানে দশরথ থেকে জাত)।

এবার গলার কথা বলছি। গলা দিয়ে খাবার গলে যায় বলেই তাকে গলা বলে। রুগীদের গলা দিয়ে শক্ত ভাত না গললে ওদের জন্য গলা ভাত চাই। গলা ভাত গলা দিয়ে খুব সহজেই গলে। গলাতে গ্রাসনালী আর শ্বাসনালী আছে, প্রথমটী দিয়ে খাদ্যের গ্রাস ও দ্বিতীয়টী দিয়ে বাতাস গলে যায়।

গলার পর বগলের কথায় আসি। বগল শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ হল ‘দুইটী গলিবার পথ’। একজনের বগলের তলা দিয়ে আর একজন মানুষ গলে যেতে পারে। হাতের শিরা, ধমনী ও স্নায়ুগুলি বগল দিয়ে গলে বাহুতে (arm-এ) আসে। বগল শব্দে ‘গল’ মানে গলা হল, কিন্তু বগলে ‘ব’ কেন? মানুষের দুইটী বগল থাকে বলে ব বর্ণ আসছে। ব মানে ২ হতে পারে, যথা বার, বাইশ, বত্রিশ (ব+ত্রিশ) ইত্যাদি শব্দে ব বলতে দুই বুঝায়। একবার একটী হাসপাতালের ব্যস্ত শিশুওয়ার্ডে একজনের বগলের তলা দিয়ে গলে পেরিয়ে যাবার সময় আমি প্রথম বগল শব্দের অর্থ (দুটী গলবার পথ) ভাল করে বুঝেছিলাম।

বুক আর পেট নিয়ে ধড় হয়। ধড় মানে যার দ্বারা প্রাণধারী গড়ান-উড়ান বা নাঁচন-কোঁদন করে (এখানে ধ বর্ণে ধারণ, ড় বর্ণে গড়ান-উড়ান)। শরীর আধার, প্রাণ আধেয়। ধড় রূপ আধার প্রাণ রূপ আধেয়কে ধরে। বাহ্যতঃ ধড় মাথাকেও ধরে, হস্তপদাদিকেও ধরে।

বুকের মধ্যে আছে ফুসফুস। এটী সর্ব্বদা ফুসফুস করে শ্বাস নেয় ও বিসর্জ্জন করে, সেই জন্যেই একে ফুসফুস বলে। এখানে ফু মানে বায়ু নির্গত করা এবং স বর্ণের অর্থ ‘নির্য্যাসত্যাগ’ (নির্গমনের শেষাবস্থা)।

এবার পেটের কথা হোক। পেট শব্দে প বর্ণে প্রাপণ, এ বর্ণে দিশাগ্রস্তন এবং ট বর্ণে টঙ্কারণ বুঝুন। পেট মানে যা কিছু পাবার জন্য বারে বারে টঙ্কার করে।

পেটের ভিতরে পাকস্থলী। সেটী পাকক্রিয়ার থলিই বটে। পাকস্থলীর পরেই আছে ডিওডেনাম (duodenum), তাকে বাংলায় গ্রহণী বলে। এটী দেখতে ইংরেজী C বর্ণের মতো। একে গ্রহণী বলে কেন? গ্রহণী পাকস্থলীর খাদ্য, অগ্ন্যাশয়ের রস (pancreatic juice) এবং পিত্তনালীর (common bile duct-এর) পিত্তকে গ্রহণ করে বলেই তার নাম গ্রহণী (গ্রহণী গ্রহণের সক্রিয় আধার, ঈ বর্ণে সক্রিয় আধার হয়)।

এবার পেট থেকে কুঁচকিতে নামা যাক। কুঁচকি সঙ্কুচিত হয় বলেই তা কুঁচকি। এই প্রসঙ্গে আরও বলি যে স্ত্রীস্তন সঙ্কুচিত হয় বলে তাকে কুচ বলে। কুঁচকি ও কুচ উভয়েই সঙ্কুচিত হয়, উভয় শব্দের মিলটা ক্রিয়াভিত্তিক। প্রসঙ্গত, স্তন থেকে দুগ্ধ নিঃসরণ (স) তারিত (ত) ও অন (ন) হয় বলে তাকে স্তন বলে।

তারপর হাঁটুর কথা। হাঁটুকে হাঁটু বলে কেন? উত্তর : হাঁটু না থাকলে হাঁটা যায় না, তাই তা হাঁটু।

তারপর পায়ের পাতা। সেটা দেখতে গাছের পাতার মতোই। পায়ের পাতায় আছে finger। সেই finger-কে অঙ্গুল বলে কেন? উত্তর : তার কারণ হল অঙ্গুল মানে ‘যার মাধ্যমে অঙ্গ (হাত, পা) নবরূপে উলায়িত হয় এবং গ্রহণার্থ যায়’ (উ বর্ণের অর্থ ‘নবরূপে উত্তরণ’)।

শিরা দিয়ে পায়ের রক্ত হৃৎপিণ্ডে যায়। প্রশ্ন : শিরাকে শিরা বলে কেন? উত্তর : তার কারণ শিরা দিয়ে শিরের দিকে (মানে, এখানে, হার্টের দিকে) রক্তপ্রবাহ যায়।

ডাক্তারবাবু হাতের ধমনী বা নাড়ীর স্পন্দন দেখেন। নাড়ীকে ধরা বলে, ধাতুও বলে। কেন বলে? উত্তর : কারণ তা শোণিত প্রবাহ ধরে রাখে। স্মরণীয় : ”দেখহ পুত্ত্রের ধাতু নাইকো শরীরে।” — চৈতন্যচরিতামৃত। এখানে ধাতু মানে নাড়ী (pulse)। রক্ত, মাংস, মেদ, মজ্জা, বীর্য্য, বায়ু, পিত্ত, কফ প্রভৃতিকেও শরীরের ধাতু বলে। ভাষা শরীরে ভূ, গম্ প্রভৃতি ধাতুর যেমন কাজ (শব্দগুচ্ছকে ধরে রাখা); মানবশরীরে এদের কাজও সেইরকম (শরীরকে ধরে রাখে)।

রক্ত, মাংস, মজ্জা, মেদ, অস্থি, স্নায়ু ইত্যাদিকে শরীরের কলা বলে। কলা মানে অংশ। এগুলি শরীরের অংশ বলেই এদের কলা বলে। এর মধ্যে রক্ত তরল যোগকলা। রক্ত রঞ্জিত বলেই তাকে রক্ত বলে। রক্তকে রুধিরও বলে। কেন বলে? উত্তর : তার কারণ রক্ত চর্ম্মশিরায় রুদ্ধ হয়ে প্রবাহিত হয় (রুধ্ + ইর = রুধির, ইর মানে গতি)।

মানুষের সমগ্র জীবনও নানা ক্রিয়ার যোগফল। মরণও একটী ক্রিয়া, তবে মরণেও মানুষের আরব্ধ সব কাজ শেষ হয় না। একটী মানুষের কাজের সঙ্গে অন্য মানুষের কাজ মিলে যায়। তাই বলা যেতে পারে জীবন একটী অসমাপিকা ক্রিয়া। প্রসঙ্গত, কবি সুকুমার রায় তাঁর ‘ক্যাবলের পত্র’ নামক রচনায় জীবনকে অসমাপিকা ক্রিয়া বলে বর্ণনা করেছেন।

বর্ণমালার প্রতিটী বর্ণের অর্থ বুঝলে বর্ণের আলোয় নিজেকে ও জগৎকে সুন্দরভাবে দেখা সম্ভব। ক্রিয়াভিত্তিক দর্শন জগৎকে অসংখ্য ক্রিয়া ও ক্রিয়াকারীর এক বিশাল সম্মিলন রূপে দেখে। semantics খুবই গভীর এবং অগাধ রসের শাস্ত্র।

ধন্যবাদ।

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গদ্য, মানবশরীর ও বর্ণমালা — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *