‘Man and Superman’-এ জর্জ বার্নার্ড শ ইসলামের চেতনার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। হান্টিংটন ‘দ্যা ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন’-এর পাশ্চাত্যের উদয় অধ্যায়ে ৮ম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্য্যন্ত সাহিত্য, বিজ্ঞান, শৈল্পিক অর্জ্জনে ইউরোপকেও ছাড়িয়ে যায়, সেটাও বলা হয়েছে। একই বইয়ের পাশ্চাত্য ও ইসলাম অধ্যায়ে বার্নার্ড লুইসের কথা উল্লেখ করে বলেছেন: ‘ইসলাম একমাত্র সভ্যতা যাকে পশ্চিমা সভ্যতা বহুকাল থেকেই ভয় পেয়ে এসেছে।’
এটাও বলা হয়েছিল ‘কম্যুনিজমের পতনের পর পশ্চিমা পূজিবাদী দেশগুলোর মনে এখন একটাই ভয় হবে সেটা হল ইসলামফোবিয়া’ কারণ, ইসলাম এবং কম্যুনিজম পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও ধনবাদী স্বার্থের বিরুদ্ধে কথা বলে।
তবে মোল্লাতান্ত্রিক ও বুর্জোয়া পূজিবাদে ঘেঁষা আমরা কি ইসলামের সেই চেতনা, ন্যায়পরায়ণতা, আদর্শ বহন করি? নবীজিকে তো শত্রুরাও বিশ্বাস করত। এখন আমরা নিজেরা নিজেদেরই বিশ্বাস করি না।
বস্তুত, কার্ল মার্ক্সের সমাজতান্ত্রিক মতবাদ আর ইসলামের সাম্যবাদ একই সরলরেখায় ছিল। কম্যুনিজমের প্রবর্ত্তক কার্ল মার্ক্সকে পূজিবাদী সমাজ ভয় পেত। কম্যুনিজম আদতে শেষ। তাই পশ্চিমাদের ভয়ের নাম এখন ইসলাম। সেটা ক্যারল আর্মস্ট্রং তার ‘ইসলাম’ বইয়েও বলেছেন।
কম্যুনিস্ট কথিত দেশ যেমন: রাশিয়া, চায়না কম্যুনিজমের নামে অনেক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। কার্ল মার্ক্সের স্পিরিটটাকে ক্ষমতায়নে ব্যবহার করে। এইসব অপব্যবহারের জন্য সার্ত্রে, ফুকো দল ত্যাগ করেন। দেরিদা মার্ক্সের স্পিরিট বিশ্বাস করত, দল করেনি এজন্য।
৯/১১-এর পর থেকেই হলিউড কিংবা বলিউড মুভিতে টেররিস্ট বলতে মুসলমানকেই দেখানো হয়। এমন ধারনা যে, ইতিহাসে রোমান, ইংলিশরাও এমন হত্যা করেনি যেমনটা মুসলিম শাসকরা করেছে। (সব শাসকই শোষণ করেছে)। এমন নয় যে, ইসলামের নামে টেরোরিজম করছে না। অবশ্যই আছে। এবং সেটা ঘৃণিত। তবে নিরন্তর মুসলিমকে টেররিস্ট হিশেবে মুভিতে দেখানো একটা মিডিয়া প্রোপাগান্ডা যা নতুন প্রজন্মের কাছে এই ধর্ম্মকে ডিফেইম করার অপচেষ্টা।
সাঈদ ‘আফটার দ্য লাস্ট স্কাই’ বইয়ে বলেন: ‘পশ্চিমে এমন একটা দিনও পার হয় না যখন ফিলিস্তিনিরা প্রধান সংবাদে পরিণত হয় না। তবে প্রচার মাধ্যম তাদের যে ইমেইজ তৈরি করেছে তা খুনী, সন্ত্রাসী, অপহরণকারী অথবা সর্ব্বহারা। ‘(অরিয়েন্টালিজম: ১৫)’
‘‘কভারিং ইসলাম’’ বইয়ে সাঈদ প্রতিদিনের সংবাদ পরিবেশন, ফিচার, প্রবন্ধ, নিবন্ধ সাক্ষাতকার ঘেঁটে দেখান পশ্চিমের প্রচারমাধ্যম দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের খুনী, সন্ত্রাসী, অপহরণকারী হিশেবে চিত্রিত করে এসেছে। ফিলিস্তিনী মুসলমানদের স্বাধীনতাসংগ্রামকে অথবা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মুখে ইরানী যুদ্ধকৌশলকে ব্যাখ্যা করা হয় সন্ত্রাসী তৎপরতা বলে’’ (অরিয়েন্টালিজম : ১৬) এ বিষয়ে ডব্লিউ সাউদার্ন দেখিয়েছেন, ইসলাম সম্পর্কে ইসলামী প্রাচ্য সংস্কৃতি সম্পর্কে পশ্চিমের ছিল উদাসীনতা ও অজ্ঞতা, এবং কোন ইতিবাচক স্তর রচিত হয়নি। (অরিয়েন্টালিজম : ৮৩-৯০)
বললে অত্যুক্তি হবে না, এই জঙ্গিগোষ্ঠী নামের ফ্রাংকেস্টাইন তৈরীতে পশ্চিমাদের পরোক্ষ ইন্ধন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার সময়। এ বিষয়ে একটা প্রাসঙ্গিক কথা বলা দরকার যে ইরাক আক্রমণের ফল যে সন্ত্রাসের সম্প্রসারণ এবং WMD এর বংশ বিস্তারে উসকানি ছিল— এ বিষয়ে অনেক বিশ্লেষক ও গোয়েন্দারা বিশেষ করে মার্কিন এন আই সি এবল সিআই-এর পরিচালক জর্জ টেনেট্ ২০০২ সালে কংগ্রেসকে অবহিত করেন: ‘আমেরিকার নেতৃত্বে ইরাক আক্রমণ হলে, রাজনৈতিক ইসলামের সমর্থকরা আরো উৎসাহ, উদ্দীপনা পাবে, এবং সহিংসতার উৎপত্তি হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে, এবং একটি নতুন পেশাগতভাবে দক্ষ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্ম নেবে।’ (ইরাক এবং সন্ত্রাসের বিরূদ্ধে যুদ্ধ অধ্যায়— ফেইল্ড ইস্টেইট— নোয়াম চমস্কি)
আমরা যদি ড্যাটা খুঁজি, দেখা যাবে ইহুদী আর খ্রিষ্টানের ক্রুশেড, বর্ণবিদ্বেষের জন্য ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী মানুষ মারা গেছে। মার্কিনীরা গত ৭৩ বছরে ৩ কোটি মানুষকে হত্যা করে। খোদ আমেরিকায়, উগ্রবাদ, বর্ণবাদ, দারিদ্র্যের কারণে গত ৫০ বছরে ৬ লক্ষ শিশুকেই হত্যা করা হয়। এখানে বলা দরকার, উগ্রপন্থী দুই ধরনের হয়— এক ধর্মান্ধ হয়ে, আবার সেক্যুলার হয়ে… যেটাকে চমস্কি নিওলিবারেল মহামারী বলেছেন আর হারারি বলেছেন ‘পূজিবাদী রাক্ষসের গোলাম’। এ প্রসঙ্গে সলিমুল্লাহ খানের জাক দারিদার ‘ত্রাসনীতি’ প্রবন্ধ থেকে একটা বিষয় টানা যায়। ফরাসি দার্শনিক মনোবিদ জাক লাঁকা জীবনের শেষে টেলিভিযনে দেয়া এক সাক্ষাতকারের কথা বলা যেতে পারে। লাঁকা বর্ণবাদের বিস্তার সম্পর্কে বলেন: ‘আগামী শতাব্দীতে পশ্চিমা সভ্যতার কথিত উন্নতি অনুন্নত দুনিয়ার বিরূদ্ধে পশ্চিমের যুদ্ধ সামনে বর্ণঘৃণা আকারেই হাজির হবে।’ ‘এবং এসলাম ও পশ্চিমার দ্বন্দ্ব, তা তো বর্ণবাদেরই নবজাগরণ। সাদা মিথলজির উত্থান সম্প্রতি আমরা দেখতে পাই আমেরিকাসহ ইউরোপজুড়ে। আর এই সাদা মিথলজির অন্যতম প্রবক্তা প্রখ্যাত ফরাসি পত্রিকা লো মোঁদ এসলাম ধর্ম প্রবর্তক পয়গম্বর হজরত মোহাম্মদের ছবি এঁকেছেন, আর নিচে লিখে রেখেছেন, পয়গম্বর মোহাম্মদের ছবি আঁকা বিধেয় নহে’। (জাক দেরিদা পাঠ ও বিবেচনা: সম্পাদনা, ফয়েজ আলম)
আর একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে গাফফার চৌধুরীর কলাম থেকে। ‘‘সালমান রুশদী যখন তার ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ উপন্যাসে হজরত মোহাম্মদ (দ.) সম্পর্কে অশ্লীল ও আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন, তখন তারা এমনকি পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীরাও তাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে বাহবা দিয়েছেন। কিন্তু ইসরাইল গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হলোকাস্টের (ইহুদি গণহত্যা) যে কথা বলে, তা ঐতিহাসিক গবেষণা দ্বারা সত্য নয় বলে বই লেখায় এক ব্রিটিশ অধ্যাপককে ব্রিটেনে চাকরিচ্যুত করে জেলে পাঠানোর জন্য তত্কালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এমনকি হলোকাস্টকে যারা বিশ্বাস করে না, তাদের জেলে পাঠানোর জন্য আইন প্রণয়নও করতে চেয়েছিলেন।’’ (দৈনিক ইত্তেফাক :আবদুল গাফফার চৌধুরী)
অন্যদিকে, ভোগবাদী মুসলিম রাষ্ট্র মূল আদর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সাম্রাজ্যবাদের তোষামোদে এবং অনুসরণে ব্যস্ত। ধর্ম্ম, হৃদয় এবং আত্নার উপলদ্ধি থেকে না হয়ে নীছক সামাজিকতায় পরিণত হয়েছে। একটা ডেমো দেয়া যায়, যদি মুসলিমদেরকে বলা হয় ভিসা পেলে কোন দেশে যাবেন? উত্তরে সবাই বলবে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কিংবা অস্ট্রেলিয়া। এর কারণ ধনতন্ত্র ও বস্তুবাদী চিন্তা সবার আগে প্রায়োরিটি দিই— পরে স্থান পায় আধ্যাত্মিক চিন্তা।
অথচ এই হীন-অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জ্ঞান, বিজ্ঞান ও চেতনার জায়গাকে বিস্তৃত করার প্রয়াস আমাদের মোল্লাতান্ত্রিক সমাজে কম। বরং মূর্খ থাকলে একটা শ্রেণীকে ব্রেইনওয়াসড্ করা সহজ হয় এবং যে কোন চরমপন্থায় ব্যবহারও করা যায়। অথচ অন্য ধর্ম্ম, মতের প্রতি নবিজী সহিষ্ণু হতে শিখিয়ে গেছেন। আদতে এখন সেটা নেই।
পরিশেষে এটুকুই বলা যায়, বিদ্যায় পরিপূর্ণ, আচরণে ঋজু, জ্ঞানে উদ্ভাসিত আর চিন্তায় বৌদ্ধিক অষ্টম, নবম, দশম… শতাব্দীতে যে মুসলিম রেনেসাঁ ছিল, তা থেকে আমরা এখন বহুদূরে— বিপন্নতায় ভুগছি। তার উপর পশ্চিমা মিডিয়া ইসলাম আর ইসলাম নামধারী কিছু জঙ্গিগোষ্ঠীকে সমান্তরালে আনার চেষ্টা করছে।
এ নিয়ে আরও ভাবনার অবকাশ আছে….
মাহবুবুল ইসলাম রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত সমসাময়িক, ইসলাম, ইসলামফোবিয়া ও পশ্চিমের রাজনীতি
হিন্দুবিদ্বেষ এবং আরবীয় সাম্রাজ্যবাদ, ইসলামী ঔপনিবেশিকতা ও আগ্রাসন নিয়ে আপনার সুচিন্তিত মতামত প্রত্যাশা করি৷ পাশাপাশি ফিলিস্তিনীদের প্রতি দরদমাখানো হৃদয় নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধীনতাপ্রত্যাশীদের ভাবনাকে বিশ্লেষণ করবেন সেই দুরাশা রেখে গেলাম৷