প্রবন্ধ যা কিছু হারায় গিন্নী বলেন, ‘কেষ্টা বেটাই চোর’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রদ্ধেয় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিশাল দুই খণ্ডে সমাপ্য ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ রচনা করেছিলেন। এহেন প্রামাণ্য অভিধানের পাতা উল্টে দেখা যাচ্ছে ‘ছাত্র’ শব্দের অর্থ— ‘গুরুর দোষাবরণশীল’। আর ‘গুরু’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘যিনি গর্ভধানাদি উপনয়ন পর্য্যন্ত সংস্কার করিয়া বেদশিক্ষা দেন’। গোল বাঁধছে এখানেই। আজন্ম সংস্কার এবং শিক্ষার প্রধান দায়িত্ব যাঁর কাঁধে, তাঁর আবার ‘দোষ’! যে ‘দোষ’ কিনা ‘আবরণ’ করবে তাঁরই হাতে গড়া ছাত্র?

সুতরাং, ‘দোষ’ বিষয়টাকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা দরকার। প্রসঙ্গত অন্তর্জালের সাহায্যে কয়েকটি প্রাচীন অভিধান ঘেঁটে যা পাওয়া গেল তা এরকম:-

दोष (দোষ)
दोष[1] : Monier Williams Sanskrit-English Dictionary (2nd Ed. 1899) m.evening, darkness (only BhP., where personified as one of the 8 वसुs and husband of Night, vi, 6, 11 ; 14)
दोष[2] : Monier Williams Sanskrit-English Dictionary (2nd Ed. 1899) m. rarely n. (√दुष्) fault, vice, deficiency, want, inconvenience, disadvantage Up. Mn. MBh. Kāv. & c. badness, wickedness, sinfulness Mn. R. offence, transgression, guilt, crime (acc. with √ऋ or लभ्, to incur guilt), S3rS. Mn. MBh. & c. damage, harm, bad consequence, detrimental effect ( नैषदोषः, there is no harm ; कोऽत्रद्°, what does it matter?) Mn. MBh. Kāv. & c. accusation, reproach (°षं√कृ or °षेण-√गम् with acc., to accuse) R. alteration, affection, morbid element, disease (esp. of the 3 humours of the body, viz. पित्त, वायु, and श्लेष्मन्, 1 [cf. त्रिदोष and धातु], applied also to the humours themselves) Suṡr. (also °षक) a calf L.

दोष : Wilson Sanskrit-English Dictionary (2nd Ed. 1832) m. (-षः)
1. Fault, defect, blemish.
2. Sin, offence, transgression.
3. Disorder of the humours of the body, or defect in the functions of bile, circulation, or wind.
4. A calf.
दोष[1] : Cappeller Sanskrit-English Dictionary (1891)
m.), mostly दोषा॑ f. evening, dark.
दोषा॑म्&दोषा॑ (instr.) in the evening, at dusk.
दोष[2] : Cappeller Sanskrit-English Dictionary (1891)
m. (n.) fault, defect, want; sin, transgression; harm, evil consequence; disadvantage, damage, bad condition.

উপরের সবকটি তথ্যসূত্র অনুযায়ী ‘দোষ’ শব্দটির লক্ষণার্থ ও ব্যঞ্জনার্থ দুই-ই খুব একটা সম্মাননাকর নয়। অতএব সংস্কৃত দূষ্ ধাতু থেকে জাত ‘দোষ’ শব্দটিকে আমরা একটি ক্ষতিকারক বৈশিষ্ট্য হিসাবেই গণ্য করে থাকি। এহেন পরিপ্রেক্ষিতে তাহলে আলোচনা করা দরকার:-
১. গুরু বা শিক্ষকের ‘দোষ’ এর আকৃতি ও প্রকৃতি কেমন?
২. ছাত্র কীভাবে ঐসকল ‘দোষ’ আবরণ করে?

(১)
গুরু বা শিক্ষকের ‘দোষ’ এর আকৃতি ও প্রকৃতি বিষয়ে আলোচনা করতে হলে সর্ব্বপ্রথমে ‘সংস্কার’ শব্দটির যথাযথ উপলব্ধি দরকার। ‘সংস্কার’ এর অর্থ প্রয়োজন অনুসারে নির্ম্মাণ বা পুনর্গঠন। অর্থাৎ যা ছিল বা আছে তাকে গড়েপিটে কোন নির্দ্দিষ্ট কর্ম্মসম্পাদনের উপযোগী করে তোলা। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে সংস্কারকারী অর্থাৎ গুরু হলেন একজন সংগঠক, যিনি সৃষ্টি নয় নির্ম্মাণ করেন। সুতরাং এই প্রসঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা বা সংস্কারপ্রবর্ত্তনার সামাজিক ইতিহাস ও উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ একান্ত জরুরী হয়ে পড়ে এবং মানবসভ্যতার তথাকথিত বিকাশধারার বাঁকগুলিকেও যথেষ্ট অভিনিবেশ সহকারে অনুধাবন করাটাও আবশ্যিক হয়ে ওঠে। আসলে, সুপরিকল্পিত সংস্কারকর্ম্মসূচীর লক্ষ্যই ছিল সভ্যতা ও শিক্ষাকে একে অপরের পরিপূরক হিসাবে জনমানসে তুলে ধরা। অর্থাৎ কিনা সভ্য সে-ই যে শিক্ষিত এবং শিক্ষিতমাত্রেই সভ্য, এমত ধারণাকে আগামীর একমাত্র অবলম্বনস্বরূপ করে তোলা। অথচ ‘সভ্য’ তাকেই বলা হয় যিনি কোন একটি বিশেষ গোষ্ঠীর বা সভার বা কর্ম্মসূচীর অঙ্গ অর্থাৎ নিয়মিত সদস্য (member) হওয়ার যোগ্য। সুতরাং একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে যে এহেন সুসংহত পরিকল্পনা প্রয়োগ ও প্রচলনের দায়িত্বে ছিলেন কোন না কোন গোষ্ঠীর প্রবর্ত্তক বা আদিগুরু, যাঁর উদ্দেশ্যই ছিল ‘গর্ভধানাদি উপনয়ন পর্য্যন্ত সংস্কার করিয়া বেদশিক্ষা’ দানের মাধ্যমে গোষ্ঠীস্বার্থ এবং গোষ্টিতন্ত্র সুদৃঢ়ভাবে সংরক্ষণ ও বিস্তার। অতএব তাঁরাই প্রাকৃতিক জীব ‘মানুষ’কে ঝাঁকজীব ‘মানুষ’ করে তোলার অর্থাৎ অখণ্ডকে ‘সংস্কার’ করে খণ্ডসংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ।

পরমাপ্রকৃতির বুকে নিরন্তর নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার ফলস্বরূপ যে আদি মানবপ্রজাতির জ্ঞানার্জ্জনের সূত্রপাত হয়েছিল এ বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই বললেই চলে। জলে স্থলে বা অন্তরীক্ষে সুপ্ত অপার প্রাকৃতিক শক্তিকে অনুভব ও উপলব্ধির মাধ্যমে যেমন তারা নিজেরা সমৃদ্ধ হয়েছিলেন তেমনই ভবিষ্যপ্রজন্মের অস্তিত্বসমৃদ্ধির সম্ভাবনাও উন্মুক্ত করেছিলেন। ল্যাটিন gnoscere, গ্রীক gno-, বা সংস্কৃত ‘জ্ঞ’ এ তিনেরই অর্থ ‘জননসাধন’ অর্থাৎ পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে নিরবিচ্ছিন্ন যোগস্থাপনা এবং যার ফলস্বরূপ ‘জ্ঞান’ এর উদ্ভব। অর্থাৎ নিজেকে অতিবৃহৎ এর অতিক্ষুদ্র অংশবিশেষ হিসাবে অনুভব ও উপলব্ধিই ক্রমশঃ মানবপ্রজাতিকে হোমিনিড থেকে হোমোস্যাপিয়েন্স স্তরে পৌঁছে দেয়। তথাকথিত উন্নতির সেই প্রথম সোপানে পা রেখে মানুষ ক্রমশঃ রপ্ত করেছে বিশ্বপ্রকৃতিময় অব্যক্ত জ্ঞানপ্রবাহকে ব্যক্তজ্ঞানের পরিভাষায় রূপান্তর প্রক্রিয়া। এইভাবে অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে আদি মানবপ্রজাতি প্রকৃতির নিয়ম মেনেই প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করতে করতে প্রকৃতিনির্ভরতার অনুষঙ্গে গড়ে নিয়েছিল তাদের চিন্তাজগৎ। স্বভাবতই তাঁরা ছিলেন ‘পরস্পর পরস্পরকে উচ্চ বলিয়া ব্যবহার’ নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু বিশ্বপ্রকৃতি যেহেতু নিরাকার ও বহুমাত্রিক তাই এহেন সমগ্রতার জ্ঞানও অব্যক্ত অনুভবের ‘ক্ষেত্র’ (উৎপাদনশীল স্থান)। অপরদিকে, ‘সভ্য’তা সর্ব্বদাই কার্য্য-কারণ, দৈর্ঘ্য-ভর-সময় এমত দ্বিমাত্রিকতা অথবা ত্রিমাত্রিকতায় সীমাবদ্ধ সাকার। তাই সভ্য হয়ে ওঠার ব্যক্তজ্ঞান পরিবেশিত হয়েছে নির্ণায়ক পরিভাষায়। তাই ‘জ্ঞানী’ ও ‘কর্ম্মী’ দুই পরিপূরক সত্তা হওয়া সত্ত্বেও ভেদবীজ বোনা হয়ে যায়, ভবিষ্যতে যা মহীরুহ হয়ে সমগ্র মানবাত্মাকেই গ্রাস করবে।

চিন্তক জীব হিসাবে নিজেদের অর্জ্জিত জ্ঞানকে অভিজ্ঞতায় সঞ্চয় করে রাখার ক্ষমতা ক্রমশঃ আদি মানবকে সর্ব্বপ্রথম যে ‘দোষ’এ দুষ্ট করে তা হল, শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকা এবং ‘জ্ঞান’কে পুঁজি হিসাবে গণ্য করা। আর তাই জ্ঞান যখন ‘সম্পদ’ হিসাবে স্বীকৃত হল, তখন উদ্বৃত্ত জ্ঞানসম্পদ যে ক্রমশঃ বিনিময়যোগ্য পণ্য হয়ে উঠবে, এতে আর আশ্চর্য্য কি? আর ঠিক এইক্ষণেই ‘পরস্পর পরস্পরকে উচ্চ বলিয়া ব্যবহার’ নীতি থেকে মানবপ্রজাতির স্খলনের সূত্রপাত। অর্থাৎ যে জ্ঞানদর্শনকে ভিত্তি করে তথাকথিত মানবসভ্যতার জয়যাত্রা শুরু তার একেবারে গোড়ায় গলদ। রক্তের শ্বেত কণিকার কাজ হল জীবাণু ধ্বংস করা, আর ‘পুঁজ’ হল মৃত শ্বেত কণিকা, সুতরাং সেই পুঁজ-ই(পুঁজি) যখন বিশ্বাস বা দর্শন হয়ে সারা দেহমনে ছড়িয়ে যায়, চারিয়ে যায় তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যায়। জ্ঞানপুঁজির প্রভাবে মানবপ্রজাতীর আন্তরিক কাঠামোতেও তাই ‘একদেশদর্শিতা রোগ’এর সংক্রমণ আটকানো যায়নি, এমনকি এটিকে রোগ হিসাবে চিনতে বুঝতে পারার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে মানুষ। ফলত অখণ্ড প্রাকৃতিক জ্ঞানকে খণ্ড করে কেবলমাত্র ‘খেয়ে পরে বেঁচে থাকার’ স্বার্থে প্রয়োগবাদী সংস্কারের প্রয়োজন ক্রমশঃ তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়া শুরু হয়-এরই অপর নাম ‘শিক্ষা’।

যত অল্প সময়ে উপরের কথাকটি বলা হল ঘটনার পট পরিবর্ত্তন কিন্তু অত অল্প সময়ে হয়নি। প্রায় কয়েক হাজার বছরের অসংখ্য ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে মোটামুটি নগরসভ্যতা পত্তনের গোড়া থেকেই গোষ্ঠিবদ্ধ/দলবদ্ধ/নাগরিক মানুষের বিচারে শিক্ষাকেই সভ্যতার মাপকাঠী হিসাবে অবিসংবাদিত প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয় এবং বাদবাকীদের অশিক্ষিতজ্ঞানে ব্রাত্য অতএব সবধরণের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার ব্যবস্থা করা হয় আর সবথেকে ভয়ংকর হল ‘সভ্য’ করে তোলার জন্য এহেন ‘শিক্ষা’র প্রভাবে অবলীলায় ‘মানুষ মানুষকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার’ করতে শুরু করে।

রবীন্দ্রনাথ লিখছেন— ‘আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান/দিয়ো তোমার জগৎসভায় এইটুকু মোর স্থান’, অতএব এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে একজন তত্ত্বজ্ঞানীর মানসিক শ্রমের উদ্দেশ্য কেবলমাত্র বস্তুগত ফললাভ নয় বা ‘উৎপাদন’ই একমাত্র লক্ষ্য নয়। কিন্তু তত্ত্বজ্ঞানই যখন উৎপাদন ও বিনিময়ের শরিক এবং পণ্যের সমপর্য্যায়ভুক্ত হয়ে যায় তখন ‘পরস্পরকে উচ্চ বলিয়া’ বিশ্বাস থেকে স্খলিত সনাতন মানবাত্মা একে অপরের পরিপূরক সত্তা থেকে পরিবর্ত্তিত হয়েছে প্রতিযোগী সত্তায়। স্বাভাবিকভাবেই দাবী উঠেছে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের, নয়তো পুঁজির সুরক্ষা হয় না। কিন্তু দাবী উঠলেই তো হল না সেই দাবীকে অধিকার (intellectual property right) পর্য্যায়ে নিয়ে যাওয়া এবং সেই অধিকারকে প্রয়োগের জন্য দরকার ক্ষমতার কেন্দ্র ওরফে ‘রাষ্ট্র’ স্থাপন করা, অতএব তাই করা হল। একেবারে প্রাথমিক স্তরে রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া হল ‘ছল’, ‘বল’, ‘কৌশল’ এই ত্রিবিধ অস্ত্র। শিশুরাষ্ট্রের কাজ হল জ্ঞানজীবীদের ভরণপোষণের আর বিনিময়ে জ্ঞানজীবীদের দায়িত্ব হল ‘ছল’, ‘বল’, ‘কৌশল’ এই ত্রিবিধ অস্ত্রে সুনিপুণ এবং দক্ষ রাষ্ট্রকর্ত্তৃক ব্যবহারযোগ্য সচ্ছল সবল ও কুশলী মানবসমাজ নির্ম্মাণ যা আদতে প্রশ্নহীন আনুগত্যে ক্ষমতার কেন্দ্রকে (পুঁজিকে) ক্রমশঃ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম দিতে বাধ্য থাকবে। সভ্যতার ইতিহাসে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিপূরক এই জ্ঞানজীবীরাই হলেন আদি ‘গুরু’ পদবাচ্য।সুতরাং জ্ঞানপণ্যের অবাধ বিনিময় সুনিশ্চিত করা ও সমাজকে রাষ্ট্রিক পুঁজির দাসত্বে অনুশীলিত করে তোলা, গুরুগণ যে এই দ্বিবিধ দোষকে মানবপ্রজাতির প্রগতির সোপান হিসাবে প্রচলন করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন এবং নেতৃত্বপ্রদান করেছিলেন এ বিষয়ে একপ্রকার নিঃসন্দেহ হওয়া যেতে পারে।

একেবারে প্রাথমিক পর্য্যায়ে এই গুরু বা জ্ঞানজীবীরা শিশুরাষ্ট্রের অভিভাবক ও পরামর্শদাতার ভূমিকায় সম্মানশ্রদ্ধার পাত্র হিসাবে বিবেচিত হতেন। কিন্তু তাঁদেরই পরম নৈপুণ্যে পুঁজির সফল বিকাশ ধাপে ধাপে ব্যক্তী থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্রকেও পুঁজিদাসে পরিণত করে ফেলামাত্র, রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রতিশ্রুতিপালনের (জ্ঞানজীবীদের ভরণপোষণের) প্রতি উপেক্ষা এবং ঔদাসীন্য প্রকট হয়ে ওঠে। অবশেষে শিশুরাষ্ট্রকে অভিজ্ঞ সাবালক করে তোলার কাণ্ডারী জ্ঞানজীবী গুরুগণের free access to knowledge সীমিতকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয় যার কুশীলব ঐ গুরুগণেরই কৃতী ছাত্রবৃন্দ। এই নব্য গুরুকুলের নেতৃত্বে অব্যক্ত জ্ঞানের যাবতীয় উৎসসমূহকে অবাধে রাষ্ট্রীয়করণ করে নির্ম্মিত হয় ‘রাষ্ট্রযন্ত্র’ আর এই রাষ্ট্রযন্ত্রের অধীনে প্রবর্তিত হয় ‘দক্ষতামূলক প্রতিযোগিতাভিত্তিক শিক্ষা’। অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্রের অনুমতি/স্বীকৃতি ভিন্ন কেউ কোনোভাবে জ্ঞানার্জ্জন করতে পারবেনা, সকলেই ‘অবগত’ হবে ‘অনুগত’ হবে। আর এভাবেই শুরু হল রাষ্ট্রগুরু, পুঁজিগুরু, যন্ত্রগুরুর ভজনার যুগ। যার ক্রমপরিণতিতে আজও মানুষ কি সামাজিকভাবে কি জাতিগতভাবে কি দেশগতভাবে একে অপরের প্রতিযোগী ছাড়া অন্যকিছু ভাবতেই পারছে না আর প্রতিযোগিতা মানেই বৈরিতা ও মাৎসর্যের অবাধ অনুশীলন, পারস্পরিক হিংসা ও দ্বেষের নিরবিচ্ছিন্ন প্রসার। অথচ পরমাপ্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা অন্যান্য জীবপ্রজাতির মত মানবপ্রজাতিরও সহজাত ধর্ম্ম হল সহিষ্ণুতা এবং সহাবস্থান (coherence and tolerance) কিন্তু গুরুকুলের নির্দ্দেশিত পথে দক্ষতা অর্জ্জনের শিক্ষা প্রকৃত প্রস্তাবে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অপরকে তার অধিকার থেকেবঞ্চিত করা, সেই অধিকার নিজে ভোগ করা এবং এই উদ্দেশ্যপূরণের লক্ষ্যে এমনকি অপরকে নিশ্চিহ্ন করা।

সুতরাং এহেন ‘শিক্ষা’র উপযোগী করে তুলতে গেলে ‘গর্ভধানাদি উপনয়নপর্য্যন্ত সংস্কার’ আবশ্যিক, কারণ ‘বেদশিক্ষা’ মানেই ভেদশিক্ষা অর্থাৎ facultisation, যা মানুষের প্রকৃতিদত্ত স্বধর্ম্ম নয়। ফলত এই সংস্কার কর্ম্মসূচী প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানবপ্রকৃতিতে কৃত্রিম যান্ত্রিকতার সংক্রমণ ঘটিয়েছে যা মনুষ্যত্বকে খাটো করে ব্যক্তিমানুষকে মহিমান্বিত করতে সদাসক্রিয়। গুরুগণের সংস্কারমুখী ভেদশিক্ষা যে যান্ত্রিকতার প্রণয়ন করেছে তা থেকে অচিরেই উদ্ভূত হয়েছে বিভিন্ন প্রকারের ‘তন্ত্র’ বা system, পরিবারতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, মোল্লাতন্ত্র, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ইত্যাকার অজস্র তান্ত্রিকতা আসলে সুকৌশলে নতুন নতুন গুরু-পদ প্রতিষ্ঠার এবং প্রতিষ্ঠান বানিয়ে তোলার এক নিপুণ প্রকল্প। আর এ তাবৎ প্রতিষ্ঠানের নিজ নিজ সংস্কারকর্ম্ম একাধারে যেমন অর্থনৈতিক পুঁজির বিকাশে নিত্যনতুন মাত্রা যোগ করেছে অপরদিকে শিক্ষা ও সভ্যতার মোড়কে মানুষের চিন্তাভাবনার ওপরেও যথেচ্ছ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে, একেই বলে মোড়কে মড়ক। স্বাভাবিকভাবেই ভেদশিক্ষিত মানুষ লোভকে আকাঙ্খা জ্ঞানে, ভোগকে প্রাপ্তি জ্ঞানে বিচার ও বিবেচনায় অভ্যস্ত হয়েছে, সৃষ্টিপরতাকে অবজ্ঞা করে নির্ম্মাণপরতার বস্তুবাদী মোহে অন্ধ হয়ে নানাবিধ আত্মবিনাশী কর্ম্মকাণ্ডে সামিল হয়েছে। প্রমাণস্বরূপ আমরা সুপ্রাচীন কাল থেকে শুরু করে আজ একবিংশ শতাব্দীতেও ‘গুরু’ এবং ‘প্রতিষ্ঠান’কে এক করে দেখে থাকি আর প্রাতিষ্ঠানিক গুরুদের ভজনকীর্ত্তন করাটাকেই সংস্কৃতির পরাকাষ্ঠা হিসাবে মান্য করি।

(২)
এতক্ষণের আলোচনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, একজন মানবশিশুকে আজন্ম নিরন্তর সংস্কারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমেই প্রাতিষ্ঠানিক গুরুর অধীনে ‘ছাত্র’ হিসাবে গড়ে তোলা হয়। একটি কাঙ্খিত পরিণামের লক্ষ্যে মানবশিশুর মানসিক গঠনকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ ও নিয়ন্ত্রণের সময়কালকেই ‘ছাত্রাবস্থা’ বলা হয়ে থাকে। স্পষ্টত এই ব্যবস্থার মূলে রয়েছে কোন বিশেষ উদ্দেশ্য। আর তা হল— কামারশালা, পাকশালা, কুমোরশালায় উৎপাদনের মতই গুরুর ‘পাঠশালা’ থেকেও ধাপে ধাপে ‘সফল নাগরিক’ ওরফে ‘রাষ্ট্রদাস’ বা ‘পুঁজিদাস’ উৎপাদন পুরোপুরি নিশ্চিত করা। তথাকথিত সংস্কার কর্ম্মসূচীর ভাবনায় ও প্রয়োগে তাই সে বিষয়ে সর্ব্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। সুতরাং একজন সফল ছাত্র খুব স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব্বের পরিচ্ছেদে আলোচিত ‘দোষ’ সমূহকেই গুরুবাক্য মনে করে আন্তরিক বিশ্বাস ও মর্য্যাদা দিতে ক্রমশঃ অভ্যস্ত হয় এছাড়া আর কোনো বিকল্প ভাবনার সুযোগ তার থাকে না, অন্তত ছাত্রাবস্থায়। আবার ছাত্রজীবনের পরিণতিতে স্বেচ্ছানিয়োজিত দাসব্যবস্থাই যেহেতু মানবজীবনের পরাকাষ্ঠাস্বরূপ বিবেচিত অতএব সেসময়েও দ্বিধাহীনভাবে মালিক, প্রভু বা employer-এর ভজনা/সেবা করে চলাই একমাত্র ধর্ম্ম, নচেৎ ভাত জোটে না। তাই গুরুর পাঠশালার সফলতম ছাত্রকেও ‘শিরদাঁড়া ঝুঁকিয়ে চলা’ নামক ‘দোষ’কে সচেতনভাবে আবরণ করে ধারণ করে জীবনাতিপাত করতে হয়। আসলে, গুরু যে সকল ‘সংস্কার করিয়া’ শিক্ষাদান করেন এবং সেসব সংস্কারের ভিতের ওপর যে ‘সচ্ছল-সবল-কুশলী’ সমাজ গঠিত হয় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই ছাত্রকুলই সেই সমাজের ধারাপ্রবাহকে সচল রাখার অন্যতম প্রধান উপাদান বা উপকরণ। এইভাবে সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে মানুষ মানুষকে ব্যবহার করাটা যে সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থা সেই সমাজ ক্রমশঃ কৃত্রিম কলাকৌশল উদ্ভাবনের ও উৎপাদনের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়। তাই সেখানে ‘ছাত্র’ মানেই ‘যন্ত্রপূজক’ আর নিয়মতান্ত্রিকতায় প্রশিক্ষিত ভাবী নাগরিক। কৃত্রিমতার পূজারী এহেন ছাত্রদলের ক্রমবর্দ্ধমান শক্তি ও প্রভাব সামাজিক সংস্কারের নামে মানবসমাজে অধিকারীভেদ ও ক্রমোচ্চ শ্রেণীবিভাগ (hierarchy) প্রবর্ত্তন করে পূর্ব্বোক্ত ‘দোষ’সমূহকে আড়াল করার পাকাপাকি ব্যবস্থা করে ফেলে। এই খণ্ডিত সমাজব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে পুঁজির বিকাশের পক্ষে অতি স্বাস্থ্যকর হওয়ার দরুণ ‘রাষ্ট্রযন্ত্র’ও যারপরনাই উপকৃত হয়, পুঁজিদাস রাষ্ট্রগুরুরাও সদলবলে বিভেদমূলক রাজনৈতিক কর্ম্মকাণ্ড পালন ও সঞ্চালনের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে দেন।যার ফলে একদা সতীর্থরা একে অপরের প্রতিযোগী থেকে শত্রুতে রূপান্তরিত হয়ে বলতে শুরু করে ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’। আত্মবিনাশী এই যুদ্ধভূমীতে/বধ্যভূমীতে ‘গুরু’ এবং ‘ছাত্র’ উভয়েরই সক্রিয় ভূমিকার মহাভারতীয় বর্ণনা থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে ‘সংস্কারজনিত শিক্ষা’ এবং ‘শিক্ষাজনিত সংস্কার’ কেন ও কিভাবে সভ্যতার অপরিহার্য্য অঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির যে গুরুকুলে ছাত্রাবস্থাতেই সততা, পাণ্ডিত্য, মননশীলতার কারণে সম্মানিত ও স্বীকৃত হয়েছিলেন মহাভারতকারেরা সেকথা আমাদের জানিয়েছেন। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যেতে পারে যে ‘গর্ভধানাদি উপনয়নপর্য্যন্ত সংস্কার করিয়া বেদশিক্ষা’য় যুধিষ্ঠির তার সমকালীন অন্যদের থেকে বেশ কয়েক গুণ বেশী শিক্ষিত ছিলেন। সে কারণেই হয়তো গুরুর ‘দোষ’ আবরণের ‘গুরুদায়িত্ব’ তাঁর কাঁধেই দেওয়া হয়েছিল এবং তিনিও ত্রুটিহীনভাবে যথার্থ কুশলী ভূমিকা পালন করে কুরুক্ষেত্রে ‘গুরু’ দ্রোণকে পুত্রের মৃত্যুসংবাদ পরিবেশন করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে গুরুহত্যার সুচতুর প্রকল্পটি নির্ম্মাণ করা হয়েছিল যুধিষ্ঠিরের মতন সচ্ছাত্রের প্রতি গুরুর ‘বিশ্বাস’ ও আস্থাকে ‘পুঁজি’ করেই। এই ঘটনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে যান্ত্রিক কৃত্রিমতা শুধু বস্তুজগতকে নয় ভাবজগতকেও সংস্কার করে ‘ছাত্র’কে একমুখী দিশাগ্রস্ত মননের অধিকারী করে তোলে। স্বভাবতই, তখন যাবতীয় দোষ-আবরণশীলতাকেই একমাত্র কর্ত্তব্যজ্ঞানে ছাত্র নিজের আন্তরিক প্রকৃতিকেও যান্ত্রিকভাবে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়, রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘যন্ত্রীর যন্ত্র কবির কাব্যকে অবজ্ঞা করিবার অধিকার পায়’ (আত্মপরিচয় ৫)। শিশু থেকে কিশোর, কিশোর থেকে যুবক হয়ে ওঠা মানে নিছক প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া নয়, প্রাপ্তমনস্ক হওয়াও বটে। কিন্তু ‘সংস্কার করিয়া বেদশিক্ষা’র মাধ্যমে অস্তিত্বের যে খণ্ডচিত্র তুলে ধরার নিরন্তর প্রয়াস চলে তার ফলে মানসিকতায় ‘পক্ষপাতদোষ’ সংক্রামিত হওয়াটা স্বাভাবিক। আর এটা এমনই অসুখ যা প্রায়শঃ ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’ জাতীয় ধারণার প্রতিষ্ঠা ঘটায়, যা একজন ছাত্রকে আজীবন বেআব্রু করতে থাকে। সমাজসভ্যতার ইতিহাসে তাই যত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দেখা গেছে, নির্ব্বিচারে ভ্রাতৃহত্যার, পিতৃহত্যার, অমানবিকতার যত সুসংগঠিত প্রকৌশল যথেচ্ছ প্রয়োগ করা হয়েছে সে সমস্তই ‘শিক্ষিত-সংস্কৃত’ মানুষেরই মস্তিষ্কপ্রসূত অবদান। আর সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, এই ‘পক্ষপাতদোষ’এর ‘আবরণ’গুলোই আবার নতুনতর আঙ্গিকে সেই পক্ষপাতিত্বেরই সম্প্রচার করেছে এবং এই ধারা এখনও বহমান। অর্থাৎ শিক্ষিত সমাজে ‘নিরপেক্ষতা’ চিরকালই ‘অধরা মাধুরী’ হয়েই ছিল এবং আছে। অতএব ছাত্র যতই ‘গুরুর দোষ আবরণশীল’ হোক না কেন, আবরণশীলতা বজায় রাখতে গিয়ে তার পক্ষপাতী না হয়ে উপায় নেই। কারণ, কোন আবরণটি যথাযথ বা সময়োপযোগী কিংবা নীতিগতভাবে মূল্যবান সে বিষয়ে সামগ্রিক বিচারবিবেচনার ক্ষমতাটিও ‘সংস্কৃত’ অর্থাৎ ‘বিশিষ্ট’ হয়ে বসে আছে।

সামন্ততান্ত্রিক গুরুদের সংস্কার ও ভেদশিক্ষার ফলে তাদের ছাত্ররা সামন্ততন্ত্রের দোষ আবরণ করতে এতটাই সক্রিয় হয়েছিলেন যে গোটা সমাজটাই আরো খণ্ডিত হয়েছিলো। অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের গুরুরা যন্ত্রের উদ্ভাবনার মাধ্যমে সামন্ততান্ত্রিক সমাজকে সংস্কার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাদের সফল ছাত্রদল বৈজ্ঞানিক প্রগতিশীলতার আবরণ (প্রযুক্তি) দিয়ে সমাজের খণ্ডগুলোকে শুধুমাত্র আড়ালটুকুই করেছেন কয়েক যুগ ধরে, জুড়তে পারেন নি। তাই আজকের বিজ্ঞানপ্রযুক্তি ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের পণ্য উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত আর বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনই আধুনিক জীবনধারার প্রস্তাবক, নির্দ্দেশক ও বিচারক। অর্থাৎ সামন্তপুঁজি চেহারা পাল্টে বেনিয়াপুঁজিকে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে, যেখানে দৃশ্যতই ‘গুরু’ এবং ‘ছাত্র’ উভয়েই নিখাদ পণ্য। কারণ বেনিয়াপুঁজির বিকাশের জন্য সমাজে ভেদভাবনার প্রসার একান্ত দরকার, তাই সংস্কারকর্ম্মে দক্ষ ‘গুরু’ প্রয়োজন আর এহেন গুরুদের নামমাহাত্ম্য প্রচারের জন্য ‘দোষ আবরণশীল’ ছাত্রও আবশ্যিক। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর আমলে ভারতভূখণ্ডে ‘বণিকের মানদণ্ড’কে ‘রাজদণ্ডরূপে’ প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য টমাস বেবিংটন মেকলে নামক ‘গুরু’কে নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁর প্রস্তাবিত সংস্কার এবং শিক্ষানীতি অনুসরণ করে পরবর্ত্তী কয়েকশ বছর ধরে গোটা ভারতীয় সমাজটাই বিশ্বের বৃহত্তম ‘বাজারে’ পরিণত হয়েছে। কথাটা দুঃখের হলেও সত্যি যে অধিকাংশ শিক্ষিত ভারতীয়ই এখন কোন-না-কোন-ভাবে পণ্যসংস্কৃতির ধারক, বাহক ও প্রচারক অর্থাৎ ‘গুরুর দোষাবরণশীল’, যারা আত্মপরিচয় বিস্মৃত হয়ে নিজেদের ক্রীতদাসত্ব জাহির করতে সদাতৎপর। ফলত শিক্ষিত দেশবাসীদের অধিকাংশই বাজারী অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীতে একে অপরের মূল্যায়ন করে আর অর্থোপার্জ্জনই তাদের শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘সংস্কার করিয়া বেদশিক্ষা’ ছাত্রকে যে বস্তুবিশ্বের প্রকারভেদ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল দক্ষ করে তোলে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। দক্ষ ছাত্র বিশ্বপ্রকৃতির সবকিছুকেই তাই ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতির সাহায্যে জানে-বোঝে। অতএব একজন সংস্কারপ্রাপ্ত ছাত্রের ‘জ্ঞানভাণ্ডারে’ স্তরে স্তরে সঞ্চিত থাকে সামঞ্জস্যহীন নানাবিধ পদ্ধতি বা নিয়ম, যা প্রয়োগ করে তারা বস্তুপৃথিবীকে পৃথকীকরণে উদ্যোগী হয়ে পড়ে। ক্রমাগত পৃথকিকরণের আর পার্থক্যনিরূপণের চেষ্টা করার ফলে ‘সাদৃশ্য’ এবং ‘পার্থক্য’ সম্পর্কে ধারণাটাই তাদের গুলিয়ে যায়, সদৃশগুলিকে পৃথক ভেবে বিচার করে আর পৃথকগুলিকে সদৃশ ভেবে একই পংক্তিতে রাখে। কিন্তু মজাটা হচ্ছে, বস্তুবিশ্বের সীমাবদ্ধতাকে সম্যক উপলব্ধির জন্য সদৃশ পার্থক্যসমূহ (similar differences) এবং পৃথক সাদৃশ্যসমূহ (different similarities) , ভাববিশ্বের এই দুই সম্ভাবনাময় পরিপূরক ক্ষেত্রের পরিচিতি একান্তভাবেই প্রয়োজন। স্বসংগঠিত হওয়ার প্রাকৃতিক প্রবণতাকে, সমন্বিত বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলার উদ্ভবের (order out of chaos) ব্যঞ্জনাময় লক্ষণগুলিকে অনুভবে নেওয়াটা অপরিহার্য্য। ফলত এহেন দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতিতে ছাত্রের মানসিকতায় ‘গুরুর দোষাবরণশীলতার’ বিকার জন্ম নেওয়াটা স্বাভাবিক আর হয়ও তাই। ‘ডিম আগে না মুরগী আগে’ এই দ্বন্দ্বের মীমাংসা খুঁজতে তাবৎ ছাত্রকুল ডিম এবং মুরগী এই দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। ডিম থেকেই মুরগী আবার মুরগী থেকেই ডিমের উদ্ভাবনার প্রাকৃতিক ছন্দপ্রবাহ তাদের বোধে ধরা দেয় না।

এই প্রসঙ্গে অতএব মানবমনের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে দু’চারকথা বলাটা জরুরী। মনস্তাত্ত্বিকদের মতে, বোধের প্রাথমিক স্তরটি হচ্ছে পার্থক্য নিরূপণের চেষ্টা অর্থাৎ ‘এটা’ আর ‘ওটা’র মধ্যে তফাৎটুকুকে চিনতে পারা। এমত প্রচেষ্টার ফলে জমে ওঠা তথ্যভাণ্ডারই পরবর্ত্তী স্তরে পার্থক্যগুলির সাদৃশ্য বুঝতে কাজে লাগে। অর্থাৎ ক আর ল এর ভেতর যা তফাৎ, শ আর য এর মধ্যেও কিংবা চ আর ঢ এর মধ্যেও যে একইরকমের তফাৎ তা বুঝে নিতে কাজে লাগে। এ যেন ঠিক ‘নেতি’ থেকে ‘ইতি’তে পৌঁছানো। অতএব শুরুতে পার্থক্য উপলব্ধি এবং পরবর্ত্তীতে পার্থক্যসমূহের মধ্যে সাদৃশ্যস্থাপনা, এই পথেই মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গী গঠনের পর্য্যায়গুলি ক্রমপরিণতির দিকে অগ্রসর হয়, এমনটাই মনোগবেষকদের উদ্ভাবনী বিবেচনা। অনুরূপভাবে চিন্তাপদ্ধতিরও স্বাভাবিক প্রবণতা হল পার্থক্য উপলব্ধি এবং সাদৃশ্যস্থাপনের ভিত্তিতে যথাক্রমে নির্ব্বাচন ও সংগ্রহ (selection and collection), যা মানবমস্তিষ্কের জ্ঞানভাণ্ডারটিকে প্রাকৃতিকভাবে শ্রেণীবদ্ধ (categorise) করে তোলে।

নীল আকাশে পাখীরা উড়ছে আর একই সাথে একটি এরোপ্লেনকেও দেখা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় নীল আকাশ ও পাখী এবং নীল আকাশ ও এরোপ্লেন এই পার্থক্যদুটী সদৃশ হওয়ার দরুণ চিন্তাপরিসরে পাখী ও এরোপ্লেন এ দুটিকে নির্ব্বাচন করে সংগ্রহ করা হল আর জ্ঞানভাণ্ডারে খেচর শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করা হল। নিবন্ধের ১নং পরিচ্ছেদে ‘জ্ঞ’ অর্থে জননসাধন বলতে পার্থক্য-উপলব্ধি, সাদৃ্শ্যস্থাপনা, নির্ব্বাচন ও সংগ্রহের উপরোক্ত মানসিক প্রক্রিয়াকেই বোঝানো হয়েছে। উল্লেখ্য বিষয় হল, প্রথম পর্য্যায়ের পার্থক্য-উপলব্ধি ও সাদৃ্শ্যস্থাপনা আর দ্বিতীয় পর্য্যায়ের নির্ব্বাচন ও সংগ্রহ, এই দুই মানসিক ধাপ একে অপরের পরিপূরক আর পরিপূরক বলেই পরিবর্ত্তনশীলও বটে। ফলস্বরূপ ব্যক্তিমানুষের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাপেক্ষে মানবমস্তিষ্কের জ্ঞানভান্ডারের প্রয়োজনমাফিক সংস্কারসাধন ঘটে একদম প্রাকৃতিকভাবেই। সেকারণেই হয়ত বিশ্বপ্রকৃতি মানবাত্মায় দু’ভাবে ক্রিয়াশীল থাকে— বাইরে প্রভাব হয়ে আর ভেতরে স্বভাব হয়ে।

অতএব মানবশিশুর প্রাকৃতিক ‘সংস্কার’ ঘটে বিশ্বপ্রকৃতির প্রভাবে আর স্ব-ভাবে তার প্রকাশ ঘটে। এহেন দ্বৈরাজ্যিক পরিমণ্ডলে ‘গর্ভধানাদি উপনয়নপর্য্যন্ত সংস্কার’ এর প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? তবে কি ধরে নিতে হবে ‘বেদশিক্ষা’ মানুষের স্বাভাবিক বিকাশের পরিপন্থী? আর পরিপন্থী বলেই ‘বর্ণাশ্রম’ প্রথা থেকে শুরু করে আজকের hierarchical society’র ক্রমোদ্ভব ও প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে গুরু এবং গুরুবাদীদের দোষাবরণের নিত্যনতুন প্রকল্পের অবতারণা? কিন্তু যে আধুনিক মানবসভ্যতা নিজেকে বিজ্ঞানসম্মত বলে প্রচার করে সেতো তাহলে আত্মপ্রবঞ্চনার শিকার। কারণ ‘বিজ্ঞান’ হল যুগপৎ ‘বিশেষ’ ও ‘বিপরীত’ জ্ঞান, আর তাই প্রতিমুহূর্ত্তে নিজের দোষত্রুটি (limitation) খুঁজে চলাই যথার্থ বৈজ্ঞানিক সংস্কার। অথচ বাস্তবে উল্টোটাই ঘটছে। বিজ্ঞানসম্মত সংস্কারের নামে বেনিয়াপুঁজিকে ফুলে ফেঁপে ওঠার জন্য আবশ্যক ছুঁৎমার্গতায় ভরে তোলা হচ্ছে মানুষের সামাজিক পরিবেশ আর তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘আধুনিকীকরণ’। আজকের করপোরেট সংস্কৃতি তো ঘোষণাই করে বসেছে ‘যে কম্পিউটার যন্ত্রে স্বচ্ছন্দ নয়, সে অশিক্ষিত’। সহজাত প্রাকৃতিক পরিচয়কে মুছে ফেলে ডিজিট্যাল পরিচিতির মাধ্যমে প্রতিটি মানুষকে তাই ‘নাগরিক’ বানানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। এ সবই ‘দোষাবরণশীলতার’ প্রকারভেদ আর প্রশ্নহীন আনুগত্যের শিক্ষালব্ধ ছাত্রদের কর্ম্মকুশলতার পরিণাম।

ভারতীয় উপমহাদেশে অর্থনৈতিক পুঁজির প্রভাব ব্যতিরেকে এবং ‘উৎপাদন ও পণ্যবিনিময়’ প্রচলন হওয়ার বহু আগে থেকেই যে কেবল শ্রমভিত্তিক সমাজব্যবস্থার প্রবর্ত্তন করা হয়েছিল তার উল্লেখ মার্কস সাহেব তাঁর জগদ্বিখ্যাত ক্যাপিটাল গ্রন্থে করেছেন। অথচ ‘উৎপাদন ও পণ্যবিনিময়’ প্রচলন হওয়ার পরে গুরুবাদী সংস্কারের প্রকোপে যে ‘হিন্দু’ সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা হয় তাতে দেখা গেছে যে ঐ ব্যবস্থা বা বিন্যাস খোলনলচে বদলে সরাসরি অর্থনৈতিক পুঁজিনিয়ন্ত্রিত ‘জাতিভেদ’ প্রথায় পরিগণিত, যার উদ্দেশ্যই হল শোষণ ও শাসন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে শতাব্দীপ্রাচীন সংস্কৃত অভিধান ‘শব্দকল্পদ্রুম’ জানাচ্ছে ‘হিন্দু’ শব্দের অর্থ— হীন দোষ যাহাদের। আশ্চর্য্য! এখানেও সেই ‘দোষ’! নিবন্ধের উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রের দোষাবরণশীলতার সুলুকসন্ধান, কিন্তু কথায় কথায় দেখা যাচ্ছে যে যুগব্যাপী নিরন্তর সংস্কারকর্ম্মের ফলে একটা গোটা সংস্কৃতিই তৈরী হয়ে বসে আছে যাহা কি না নিজেই একটি ‘দোষ’। তাই ‘থুতু ওপরের দিকে ছুঁড়লে নিজের গায়েই এসে পড়ে’ এই সুপ্রচলিত প্রবাদ অনুসারে উক্ত ‘হিন্দু’ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা জনসমাজ বংশানুক্রমিক সচেতনায় ‘দোষাবরণশীল’। আর শুধু তাই নয় সংস্কৃত এবং শিক্ষিত সারা বিশ্বের এহেন ‘কাঁচের ঘরের বাসিন্দারা’ সর্ব্বদাই অপরাপর সংস্কৃতির দিকে ‘ঢিল ছুঁড়তে তৎপর’ যাতে খুব কাছ থেকে কেউ তাদের দোষগুলোকে সহজে চিনেবুঝে নিতে না পারে। পারমাণবিক মারণাস্ত্র নির্ম্মাণের গবেষণা সে কারণেই মানুষের অত্যাধুনিক সংস্কৃতিতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে স্বীকৃত এবং প্রায় প্রতিটি উন্নত(!) মানবগোষ্ঠী সেই সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করার প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই নিজের নিজের ‘দোষাবরণশীল’। কোন একটি তথাকথিত অনুন্নত জনগোষ্ঠীকে সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষিত করে তুলে তার প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষপ্রবণ করে তোলা আর সেই সুযোগে পারমাণবিক মারণাস্ত্রের প্রযুক্তি বিক্রি করা এসবই হল দোষ আর দোষাবরণশীলতার সুপরিকল্পিত অত্যাধুনিক পরম্পরা।

(৩)
ধরা‎‎‎ যাক একটি পাথরের টুকরোকে শুধু হাতের সাহায্যে শূন্যে ছুঁড়ে দেওয়া হল। পেশীর ক্ষমতা, অভিকর্ষ বল, হাওয়ার ঘর্ষণ এইসব প্যারামিটারের ভিত্তিতে পাথরটা কতদূরে গিয়ে পড়বে এবং তার সঞ্চারপথের (trajectory) চিত্রলেখ কীপ্রকার হবে তা নির্ণয় করা সম্ভব। পাথরের আয়তন পাল্টে গেলে কিংবা নিক্ষেপকারী বদলে গেলে গতিবিদ্যার(dynamics) গাণিতিক নিয়মে ফলাফলের প্রাসঙ্গিক পরিবর্ত্তনকেও আগে থেকে নির্দ্ধারণ করা যায়। কিন্তু নিক্ষিপ্ত পদার্থ যদি কঠিন পাথর না হয়ে এক আঁজলা জল বা গ্যাসীয় কিছু হয় তবে কি তার সঞ্চারপথ এবং পরিণতি সম্পর্কে এবম্প্রকার সুনির্দ্দিষ্ট গাণিতিক বিবেচনা সম্ভব? উত্তর— না। এই ঘটনা থেকে এমত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যেতেই পারে যে পদার্থের প্রাথমিক অবস্থায় যদি নির্দ্দিষ্ট স্থায়ী আকার এবং আয়তন না থাকে অর্থাৎ আন্তরিক গঠনে পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে,পদার্থটি যদি সরল একরৈখিক নিয়মে (simple linear system) সংগঠিত না হয়ে সম্পূর্ণ অরৈখিক (nonlinear complex system) ভাবে সংগঠিত হয়, সেক্ষেত্রে তার সঞ্চারপথ (trajectory) এবং পরিণতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণাধীন রাখা যায় না। সুতরাং বিপরীতক্রমে বলা যায় যে কোন গতিশীল সত্তার পরিণতিকে নিশ্চিত করতে হলে সঞ্চারপথটিকে বাঁধা ছকে রাখতে হবে আর সঞ্চারপথটিকে বাঁধা ছকে রাখতে গেলে পদার্থের প্রাথমিক দশাটি সরল একরৈখিক নিয়মে (simple linear system) সংগঠিত করতে হবে। এর থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, যা গুণগত ও মাত্রাগতভাবে লাগামহীন স্বতস্ফূর্ত্ত তাকে সুনির্দ্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালনার জন্য তার অন্তর্কাঠামোটাকে লাগাম পরিয়ে নির্দ্দিষ্ট মাত্রায় বেঁধে ফেলাটা জরুরী, দিশাগ্রস্ত করে তুলতে দশান্তর ঘটানোটা আবশ্যক।

পরিবর্ত্তনশীলতা এবং স্বসংগঠনই হল জীবনের বহুমাত্রিক ধর্ম্ম, যা মানুষের আজন্মশৈশব থেকে কৈশোর স্ব-ছন্দে স্ব-ভাবে সক্রিয় থাকে। গুণগত ও মাত্রাগতভাবে লাগামহীন এই দশাকে যথাবিহিত নিয়ন্ত্রণ করাই ‘গর্ভধানাদি উপনয়ন পর্য্যন্ত সংস্কার’, নয়তো জীবনের সঞ্চারপথটিকে মসৃণ সাবলীলতায় ‘বেদশিক্ষা’র উপযোগী করে তোলা যাবে না। আর ‘গুরুদায়িত্ব’ পালন মানে হল এই কাজটিকে অভ্যাসিত দক্ষতায় সম্পাদন করা। অতএব ‘দোষ’ তো থাকছেই আর দোষ থাকলে দূষণ থাকবেই, গুরুকুলে ছাত্ররা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যে দূষণের প্রভাবে বিবেচনাশক্তি হারিয়ে ‘দোষ’কেই ‘গুণ’ ভেবে বসে আছে। সে কারণেই তারা ছল-বল-কৌশল প্রয়োগ করে জীবনের সঞ্চারপথটিকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করে আর সুরক্ষা মানেই হল আরও বেশী বেশী করে দোষাবরণশীল হওয়া, নিরাপত্তার অভাববোধে ভুগে চলা, চারপাশের সবকিছুকেই সন্দেহের চোখে দেখা। দশান্তরিত এহেন ছাত্রজীবনই সভ্য সমাজের মাননির্দ্ধারক, যে সমাজে যত বেশী সংখ্যায় গুরুকুল আছে সেই সমাজকেই তত বেশীমাত্রায় ‘সভ্য’ শিরোপা দেওয়া হয় আর তারা তত বেশী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ক্রমান্বয়ে অনুশীলিত এহেন সংস্কারের ফলস্বরূপ এই সমাজ এতটাই দূষিত ব্যাধিগ্রস্ত হয়েছে যে বেশ কিছুকাল আগে থেকেই নিয়ন্ত্রণসাপেক্ষে ‘চিন্তা’র অনুমোদন দেওয়ার প্রথা চালু হয়েছে, উদ্ভাবনী চিন্তা এবং প্রযুক্তিক কার্য্যকলাপ এবম্প্রকার বিভাজন প্রকট হয়েছে। আসলে উদ্ভাবনী চিন্তা যেহেতু অসীম সম্ভাবনাময় সমগ্রতার অনুধাবন করে তাই প্রাকৃতিক স্বতোৎসারণই (self-generation) তার বিবেচ্য কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যমুখী ‘সংস্কার’ উদ্ভাবনী চিন্তার পূর্ব্বশর্ত্ত হিসাবে গণ্য হয় না। অপরপক্ষে কার্য্যকারণ বিভাজনের ভিত্তিতে দক্ষতা এবং ছলচাতুরীর মাধ্যমে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং প্রয়োজনমাফিক ব্যবহার করাই হল প্রযুক্তিক কার্য্যকলাপের সুনির্দ্দিষ্ট অভিমুখ। মহাভারতখ্যাত মধ্যমপাণ্ডব অর্জ্জুন যার সর্ব্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। ‘সংস্কার করিয়া বেদশিক্ষা’য় শিক্ষিত সমাজ ও সভ্যতা যে কোনো বিষয়কে শুধু খণ্ড করে দেখতেই শেখে আর মনে করে, যত বেশী খণ্ড তত সহজে বিষয়টাকে আয়ত্ত করা যাবে। ফলত অধিকাংশ খণ্ডই সমগ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আর এহেন পদ্ধতি সর্ব্বজনগ্রাহ্য করে তোলার কারণে মূল বিষয়টি তার বৃহত্তর প্রেক্ষিত থেকে, প্রকৃতি থেকে এতটাই অবচ্ছিন্ন যে সেই বিষয় সম্পর্কিত সমস্ত ধারণাই অসম্পূর্ণ, সংকীর্ণ, পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু সত্য বা প্রাকৃতকে জানতে বুঝতে গেলে ওইসব খণ্ডকে জুড়ে জুড়ে সমগ্রের ধারণায় পৌঁছতে হয়, যা ছাত্রের ‘সংস্কৃত মস্তিষ্কের’ পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে রাখা পাখীর চোখকেই একমাত্র করে দেখতে শেখা অর্জ্জুন গুরুকুলে সর্ব্বোচ্চ সম্মানে উত্তীর্ণ হচ্ছেন অথচ অসীম অনন্ত সম্ভাবনার ‘কুরুক্ষেত্রে’ এসে দাঁড়ানোমাত্র কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ছেন, গুরুকুলে অর্জ্জিত যাবতীয় সাফল্যের খতিয়ান কোনো কাজেই লাগছে না। অবশেষে তাঁর সংস্কৃত খণ্ডবাদী ‘দোষ’কে ‘বিশ্বরূপদর্শনের’ (synergy effect) মাধ্যমে ‘আবরণ’ করে তবেই কার্য্যোদ্ধার করতে হচ্ছে।

সংস্কার থেকেই যে সংস্কৃতির উদ্ভব এটা অনস্বীকার্য্য। তাই খণ্ডবাদী সংস্কার থেকে যে খণ্ডবাদী সংস্কৃতির বিকাশই স্বাভাবিক। আর এই খণ্ডবাদিতার দোষ ঢাকতে গিয়ে শুধুমাত্র চিন্তাকে নয় চিন্তা বা ভাবের বাহন ভাষাব্যবহারকেও নিয়ন্ত্রণ করে ক্রমাবলুপ্তির পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছে অথবা অশ্লীল হিসাবে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। অথচ বৌদ্ধসাহিত্য, গায়ত্রীমন্ত্র ইত্যাকার অনেকানেক মার্গদর্শক পর্য্যায়ের গ্রন্থ ও স্তোত্রাবলীতে ঐসব ভাষাব্যবহারের অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে যেগুলি অস্তিত্বের স্বরূপ ও প্রেক্ষিত সম্বন্ধে উদ্ভাবনী চিন্তার গভীর ব্যঞ্জনাময় উপস্থাপনা হিসাবে আজও বিকল্পহীন। মুশকিলটা হল যে গুরুকুলের সর্ব্বোত্তম ছাত্রকে তার জ্ঞানক্ষুধার নিরসনের জন্যই হোক অথবা পরীক্ষায় ভাল ফলের আশাতেই হোক ঐসমস্ত গ্রন্থের সাহায্য নিতেই হয় অথচ মনের ভাবপ্রকাশের ক্ষেত্রে তাকেই আবার সংস্কারজনিত ভাষানিয়ন্ত্রণ মেনে চলতে হয়। এই আত্মপ্রবঞ্চনাকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া তাদের সাধ্যাতীত, তাই দোষ আবরণের উপলক্ষ হিসাবে তারা পুঁজিদাস হয়ে ধনসম্পদের পিছনে, রাজনৈতিক ক্ষমতার পিছনে দৌড়ে বেড়ায়। পুঁজিতন্ত্রের খণ্ডিত সত্তার সঙ্গতিপূর্ণ ভাষা এবং আচরণে অভ্যস্ত নাগরিক হয়ে ওঠে। আসলে ‘গর্ভধানাদি উপনয়ন পর্য্যন্ত সংস্কার’ বিষয়টাই আদ্যোপান্ত একধরণের প্রযুক্তি, যার সাহায্যে সৃজনশীলকে উৎপাদনশীল করে তোলা হয়। আর উৎপাদনশীল মানেই হল পণ্যসংস্কৃতির স্রোতে গা ভাসানো। সুতরাং ‘বেদশিক্ষা’ও আদতে উপযোগিতার ভিত্তিতে ধূর্ত্ততার সঙ্গে নির্দ্দিষ্ট কর্ম্মসম্পাদনের দক্ষতা অর্জ্জন ছাড়া আর কিছু নয়।

একটি বহুল প্রচলিত শ্লোকে বলা হয়েছে ‘জন্মনা জায়তে শূদ্রঃ/সংস্কারাৎ দ্বিজমুচ্যতে’ আর শাস্ত্রানুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন বর্ণের মানুষজনই সংস্কারপ্রাপ্ত ‘দ্বিজ’ হিসাবে স্বীকৃত। প্রসঙ্গত হিন্দু শাস্ত্রে যে দশবিধ সংস্কারের উল্লেখ আছে তার সুনির্দ্দিষ্ট উদ্দেশ্যই হল একটি সুসংহত মানবগোষ্ঠী তৈরি করা। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ঐ সুসংহত মানবগোষ্ঠীটি প্রকৃতপক্ষে সংস্কারপ্রাপ্ত মতান্তরে আলোকপ্রাপ্ত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন বর্ণের (দ্বিজদের) কুক্ষিগত ক্ষমতার কেন্দ্র, যার উল্লেখ ১ নং পরিচ্ছেদে করা হয়েছে। এই যদি পরিস্থিতি হয়, তবে সর্ব্বাগ্রে যে প্রশ্ন উঠে আসে তা হল— যদি সকলে শূদ্র হয়েই জন্মায় (জন্মনা জায়তে শূদ্রঃ), তবে সংস্কার ও বেদশিক্ষার নামে সম্পূর্ণ কৃত্রিম একটি ক্ষমতাকেন্দ্র নির্ম্মাণ করে সমাজকে বিভাজিত করা এবং বৃহত্তর অংশকে অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার এমত প্রকল্পটি দোষণীয় নয় কি? আর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে স্পষ্টভাবে বেরিয়ে আসে যে, এ হল সেই ব্যবস্থা যা তথাকথিত সভ্যতার সূচনাকাল থেকেই প্রাকৃতিক harmonyকে উপেক্ষা করে মানবসমাজে স্থায়ী কর্ত্তৃত্ব(hegemony)’র প্রবর্ত্তন করেছে। অতএব ‘শিক্ষিত’ মানুষের মানসিক কাঠামোটাই যুগ যুগ ধরে কর্ত্তৃত্বকেন্দ্রিক ভাবনায় গড়ে উঠছে, ‘পরস্পরকে উচ্চ বলিয়া ব্যবহার’ সমাজসভ্যতা থেকে পুরোপুরি অবলুপ্ত। অধোগতি শুধু এখানেই থেমে থাকেনি, প্রাকৃতিক বিন্যাসের যৌক্তিকতাকে অবজ্ঞা করে প্রায়োগিক হয়ে ওঠার তাগিদে বিভিন্ন রকমের যান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমাজসভ্যতার নিয়ন্তা হিসাবে বরণ করে নেওয়া হয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষকে তাই যান্ত্রিক যৌক্তিকতার (mechanical rationality) সাপেক্ষেই অপরিবর্ত্তনীয়(irreversible)কে পরিবর্ত্তনীয় (reversible) হিসাবে বোঝানো-জানানো হচ্ছে, যার ফলে কর্ত্তৃত্ব করবার অদম্য চাহিদা বিষাক্ত ব্যাধির মত সমাজদেহের কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ছে। দোষাবরণশীলতার এও একটা কারণ বৈকি!

উদাহরণস্বরূপ ঘড়ী নামক যন্ত্রটির কথাই ধরা যাক্। ঘড়ীর ভেতরকার যাবতীয় যান্ত্রিক কলাকৌশল নিউটনীয় গতিসূত্রের ভিত্তিতে সংগঠিত এবং পরিচালিত। কিন্তু নিউটনীয় সংশ্লেষণ (synthesis) জড়বিজ্ঞানের পরিধিতে সীমায়িত। অতএব বিশ্বপ্রকৃতির যাবতীয় ঘটনাকেই ঘড়ী ধরে চলে বা চালানো যায় এমত যৌক্তিকতায় ব্যাখ্যা করতে যাওয়ার মানে হল বিশ্বপ্রকৃতিকে এমনই একটি জড়বস্তু বা যান্ত্রিক রোবোট হিসাবে ভাবা যার ওপর চাইলেই কর্ত্তৃত্ব ফলানো যায়। বিশ্বপ্রকৃতির ওপর এই কর্ত্তৃত্বের স্বীকৃতি পাওয়া মানেই ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ হয়ে ওঠা আর বাদবাকী ‘সাধারণ’এর ওপর কর্ত্তৃত্বের অধিকার পাওয়া। ১নং পরিচ্ছেদে এই পরিণতিকেই ‘মানুষ মানুষকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার’ বলা হয়েছে।

শ্রদ্ধেয় হরিচরণকৃত বঙ্গীয় শব্দকোষ অনুযায়ী ‘গর্ভাধান’ শব্দের অর্থ— ভ্রূণোৎপাদন এবং ‘পুংসবন’ শব্দের অর্থ— পুত্রের প্রসবসাধন, পুত্রোৎপত্তিকারণ। অতএব আধুনিক সভ্য সমাজে গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গনির্দ্ধারণই যখন আইনত দোষণীয়, সেই বিচারে বেদশিক্ষার পূর্ব্ববর্ত্তী প্রাথমিক দুটি সংস্কার (গর্ভাধান ও পুংসবন) যা নিছক লিঙ্গনির্দ্ধারণ নয় লিঙ্গনির্ম্মাণ, গর্হিত অপরাধ হিসাবেই বিবেচনা করা উচিৎ! অর্থাৎ ‘সভ্যতা’ নিজেই নিজের তথাকথিত বিকাশের উৎসটিকে ‘দূষণ’ বলে চিহ্নিত করছে। আভিধানিক অর্থদুটি থেকে আরও একটা বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে যে ২নং পরিচ্ছেদে উল্লিখিত ‘পক্ষপাতদোষ’ তবে ছাত্রাবস্থাতে নয়, গুরুর কৃপায় একটি মানবভ্রূণের উৎপত্তিক্ষণ থেকেই সংক্রামিত। আর এই সংক্রমণ নিয়ে যারা ভূমিষ্ঠ হচ্ছে তারা যে বয়োপ্রাপ্তির সাথে সাথে তাদেরই ‘সুসংহত মানবগোষ্ঠী’র প্রতি পক্ষপাতিত্ব (দোষাবরণ) করবে সেটা স্বাভাবিক কারণ সেটাই তাদের জীবনযাপনের পূর্ব্বনির্ধারিত সঞ্চারপথ (trajectory)। কর্ত্তৃত্বসুলভ মানসিকতা বিকাশের এ হল একেবারে প্রাথমিক ধাপ। এভাবেই ক্রমশঃ ধাপে ধাপে মানবসভ্যতায় পুরোহিততন্ত্র, রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র ইত্যাকার সামাজিক কাঠামোর উদ্ভব ও বিকাশ সম্ভবপর হয়েছে আর যুগপৎ পক্ষপাত ও কর্ত্তৃত্বের বদান্যতায় ‘সংস্কার করিয়া বেদশিক্ষা’র নিরন্তর প্রসার ঘটেছে। সমাজভ্রূণে এহেন সংক্রমণ এতটাই দৃঢ়মূল যে পরবর্ত্তিকালে শ্রেণীহীন-শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক কাঠামোতেও দোষাবরণশীলতার অবাধ অনুশীলন করা হয়েছে পুরোমাত্রায়, সাম্প্রতিক অতীতে চীন, পূর্ব্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশ এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘটনাবলী তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর। গণতন্ত্রের ব্যাপারটা পক্ষপাত ও কর্ত্তৃত্বের আরও সূক্ষ্ম এবং কুশলী প্রয়োগ। সেখানে আলাদা আলাদা সুসংহত মানবগোষ্ঠী তাদের স্ব স্ব গুরুদের কর্ত্তৃত্বে বা নেতৃত্বে যথাক্রমে পুরোহিততন্ত্র, রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, সমাজতন্ত্র, পুঁজিতন্ত্র এবং আরও আরও সামাজিক সংস্কারের ধ্বজাবাহক বা অন্ধ সমর্থক। গণতান্ত্রিক পরিভাষায় এরা রাজনৈতিক দল হিসাবে অভিহিত। নীতিগত বা দুর্নীতিগত পার্থক্য যা-ই থাক না কেন এরা সকলেই ‘রাষ্ট্র’ নামক ক্ষমতার কেন্দ্রটিকে যেন-তেন-প্রকারেণ (ছলে-বলে-কৌশলে) টিকিয়ে রাখতে চায় আর এইজন্য প্রাকৃতিক নির্ব্বাচনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে সম্পূর্ণ কৃত্রিম নির্ব্বাচনপদ্ধতি (election) নির্ম্মাণ করে ও প্রয়োগ করে। পক্ষপাত ও কর্ত্তৃত্বের পরাকাষ্ঠাস্বরূপ এই সম্পূর্ণ কৃত্রিম নির্ব্বাচনপদ্ধতি প্রত্যক্ষে এবং পরোক্ষে নানাধরণের যান্ত্রিক পরিকাঠামোর ওপর নির্ভরশীল, তাই এবম্প্রকার ‘গণতান্ত্রিক’ মানবগোষ্ঠীতে ‘election machinery’ একটি বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ। আদতে এটি হল গণতান্ত্রিক সংস্কারে প্রশিক্ষিত ছাত্রকুল যারা একাধারে নিজেদের সুসংহত মানবগোষ্ঠী ওরফে রাজনৈতিক দল ও অপরদিকে রাষ্ট্রের দোষাবরণ করতে ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’ নীতিতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সক্রিয় থাকে।

আধুনিক সমাজে যাকে রাজনৈতিক দল বলা হচ্ছে অতীতে তা-ই ছিল পরিবার বা গোষ্ঠী আর পৃথিবীর প্রায় সর্ব্বত্র প্রতিটি ক্ষমতাশালী পরিবার বা গোষ্ঠীতে কাউকে না কাউকে ‘কুলগুরু’ পদে নিয়োগ করা হত। বোঝাই যায় যে ঐ কুলগুরু পদাধিকারী ব্যক্তীরাই পরিবারতন্ত্র বা গোষ্ঠীতন্ত্রের ধারাটিকে সুরক্ষিত রাখার জন্য নিরন্তর প্রয়োজনীয় সংস্কারকর্মের পুরোহিত।স্বাভাবিকভাবেই কুলগুরুদের ভরণপোষণের দায়িত্ব ছিল পরিবার বা গোষ্ঠীর অর্থাৎ কুলগুরুরা ছিলেন পেশাজীবী। সুতরাং ‘খেয়ে পরে বেঁচে থাকার’ জন্য যাঁরা শিক্ষকতায় নিযুক্ত হতেন বা এখনও হচ্ছেন তাঁরা ‘সংস্কার করিয়া’ যে ‘শিক্ষাদান’ করবেন সেটাও ঐ নিছক ‘খেয়ে পরে বেঁচে থাকার’ শিক্ষাই যে হবে সে বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ কম। আর এহেন শিক্ষা পেতে পেতে ছাত্ররাও যে হীন ক্ষুন্নিবৃত্তিতেই সম্পূর্ণত তাদের বিশ্বাস এবং আস্থা জ্ঞাপন করবে এতে আশ্চর্য্যের কিছুতো নেই। সমাজসভ্যতা একথা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে বলেই তাকে পরম্পরাগতভাবেই ‘দোষাবরণশীল’ হতে হয়েছে, বলতে হয়েছে— দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। কারণ কারণ ‘দোষ’ যার আছে সেই তো ‘দুষ্ট’, তাই ‘দুষ্টের দমন’ করা মানেই দোষাবরণ করা আর ‘শিষ্ট’ মানে হল taught, directed, ordered, educated, disciplined । অতএব সমাজসভ্যতার একমুখী দিশাগ্রস্ততার status quo বজায় রাখার স্বার্থেই শিষ্টের পালন আর ‘শিষ্ট’ থেকেই বি-শিষ্ট হয়ে ওঠার বা করে তোলার যাবতীয় প্রক্রিয়ার সূচনা যা ক্রমশঃ গোটা সমাজদেহটাকেই বিশ্লিষ্ট করে সংস্কার করতে উদ্যোগী হয়েছে। ফলত মানবসমাজে ordered এবং disordered, disciplined এবং undisciplined এককথায় obedient এবং disobedient এমত বিভাজনের উদ্ভব। স্পষ্টই বোঝা যায় যে বা যারা ‘সংস্কার করিয়া বেদশিক্ষা’ প্রকল্পের আওতায় নেই বা এই প্রকল্পকে যথাযথ মান্যতা দিতে অস্বীকৃত সে বা তারাই অব-শিষ্ট শ্রেণী।

সুতরাং দোষাবরণশীলতার নামে হয় দমনপীড়ন নাহয় ভোগবাদী বিজ্ঞাপনের সাহায্যে ঐ অবশিষ্টদের ‘কাছে টানার’ বিবিধ পরিকল্পনা। ‘মানুষকে কলের নিয়মে বাঁধার আশ্চর্য্য সফলতা আছে; তাতে পণ্যদ্রব্য রাশী-কৃত হয়, বিশ্ব জুড়ে হাট বসে, মেঘ ভেদ করে কোঠাবাড়ী ওঠে। এ দিকে সমাজব্যাপারে শিক্ষা বল, আরোগ্য বল, জীবিকার সুযোগসাধন বল, নানাপ্রকার হিতকর্ম্মেও মানুষের ষোলো আনা জিত হয়। কেননা, পূর্ব্বেই বলেছি, বিশ্বের বাহিরের দিকে এই কল জিনিসটা সত্য। সেইজন্যে এই যান্ত্রিকতায় যাদের মন পেকে যায় তারা যতই ফললাভ করে, ফললাভের দিকে তাদের লোভের ততই অন্ত থাকে না। লোভ যতই বাড়তে থাকে মানুষকে মানুষ খাটো করতে ততই আর দ্বিধা করে না।’ (রবীন্দ্র-রচনাসমগ্র > প্রবন্ধ> শিক্ষা> সংযোজন) আসলে deterministic দৃষ্টিভঙ্গীতে গড়ে তোলা সমাজে ‘স্বতস্ফূর্ত্ত সৃজনশীলতা’ চিরকালই চরম আশংকাজনক বিষয়,আর তাই ক্রমাগত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে চলা সভ্যতায় ‘সংস্কার করিয়া বেদশিক্ষা’র আচার-বিচার-উপচার-সম্প্রচারের গোঁড়ামি। তবু সংস্কারের বজ্র আঁটুনি’র ফাঁক গলে যদিবা কেউ কখনো সৃজনশীল হয়ে পড়ে তার জন্যেই তো ‘একলব্য’ জাতীয় নিদান রাখা থাকে। স্ব-ভাব কে নির্দ্দিষ্ট ছাঁচে ঢেলে সংস্কারের মাধ্যমে ‘সভ্য’ করে তোলার মানেই প্রাকৃতিক স্বকীয়তার প্র-ভাব থেকে বিচ্ছিন্ন করা, অতএব প্রতিক্রিয়াতো হবেই। অরূপরতনের টানে সৃজনশীলতার স্বতঃ বিকাশকে (self-generation) সংস্কারমুখী সভ্যতা কোনোকালেই ভালো চোখে দেখেনি, সুদক্ষ গুরু নিয়োগ করে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অবিনাসম্বন্ধকে শাসন এমনকি অপনয়ন (elimination) করতে সচেষ্ট হয়েছে বারংবার। শুধু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই নয়, মানবদেহকে তার মন বা মনন থেকেও বিচ্ছিন্ন করে সভ্যতার শাসন অতি-সক্রিয়তা এবং দেহবাদী সংস্কারের পথে হেঁটেছে। ফলত দেহসর্ব্বস্ব জ্ঞানশাখার গুরুরা করে-কম্মে খেয়েছেন আর ছাত্ররাও সেইসব ‘মহাজ্ঞানী মহাজনদের’ অনুসরণ-অনুকরণ করে সমাজসংসারে পেশী-শক্তির কর্ত্তৃত্ব কায়েম করে যাবতীয় দোষাবরণ করেছে। যে কারণে মানবসমাজে গুরুবাদী সংস্কারের চরমতম বিকাশ সত্ত্বেও ‘জোর যার মুলুক তার’ জাতীয় ধারণারও প্রসার হয়েই চলেছে অর্থাৎ মানসিক পঙ্গুত্বের সম্ভাবনা প্রকট হচ্ছে। আর হবে না-ই বা কেন? সংস্কারমুখী ‘শিক্ষা’র যথার্থ দোসর হিসাবে আজীবন দাসত্বের ‘দীক্ষা’ যে রয়েছে। যুগে যুগে তাই ভিন্ন ভিন্ন চেহারায় ‘দাসব্যবসায়ী’দের হাতেই তুলে দেওয়া হয়েছে সমাজজীবনের গতিপ্রকৃতি নির্দ্ধারণের দায়ভার। যারা সময়ে সময়ে ‘দোষাবরণের’ বিচিত্র সব পসরা সাজিয়ে বিজ্ঞাপনী চমকের সাহায্যে গোটা সমাজটাকে শুধরে দেওয়ার কথা বলছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রবিরোধী দুয়েরই ভাষাগত ভিন্নতা থাকলেও ভাবগত অভিন্নতা একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, অর্থাৎ কিনা ‘দাসব্যবসায়ী’দের কাছে দুপক্ষেরই টিকি বাঁধা। সুতরাং সত্যিকারের জ্ঞানচর্চ্চা কবে থেকেই চলে গেছে বাতিলের খাতায়। সংস্কারমুখী সভ্যতা ‘জ্ঞানচর্চা’কে একটি prescheduled programme হিসাবে বিবেচনা করে, আদতে তা হল বিবিধ সংস্কারপ্রণালীর (deductive reasoning) সাহায্যে নিরন্তর deduction আর তারপর সীমিত (closed) পরিসরে সেইসব deduced তত্ত্বের প্রত্যক্ষ অনুমোদন এবং সমর্থন আদায়ের চেষ্টা। সংস্কারের ভিত্তিতে খাড়া করা এহেন পাঠ্যক্রমে যা-ই হোক না কেন তাকে ‘চর্চ্চা’ বলা চলে না বড়জোর ‘চর্য্যা’ বলা যেতে পারে। এককথায়, deductionism-এর ভ্রান্তি থেকে উৎপন্ন হয় reductionism এর বিভ্রান্তি, যা থেকেই ‘শিক্ষিত’/‘সভ্য’ নাগরিকদের চিন্তাচেতনার জগতে identity crisis তৈরী হয় আর প্রত্যেকে আরো বেশী বেশী করে দোষ খুঁজতে এবং দোষাবরণ করতে উৎসুক হয়ে পড়ে। আসলে গুরুকৃত সংস্কার আর শিক্ষিত ছাত্রের দোষাবরণশীলতা এ দুইয়ে মিলে যে নিশ্চিন্ত নিরাপত্তার কৃত্রিম বাতাবরণ, তাকে নিশ্ছিদ্র করে তোলাই সংস্কারমুখী সভ্যতার তথাকথিত ‘জ্ঞানচর্চ্চা’র অভিমুখ। তাই ‘সভ্য’ সমাজ ‘জ্ঞানচর্চ্চা’ বলতে বোঝে, সমাজগঠনের natural dynamic systemটাকে ভেঙেচুরে mechanical system হিসাবে deduce করা। সেখানে জ্ঞ, জ্ঞান, know শব্দের অর্থ to make intercourse with নয় তার পরিবর্ত্তে ‘knowledge’ হিসাবে যা স্বীকৃত হয় তা হল কিছু deduced and reduced form, যার না আছে সম্ভাবনাময় গভীরতা না আছে বহুমাত্রিক ব্যাপ্তি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এহেন deduced and reduced form এর ‘knowledge’ সমাজমানসিকতার steering wheel হয়ে ওঠার দরুন সংস্কারকর্ম্মটাই ‘সংস্কৃতি’ আর দোষাবরণশীলতাই ‘কীর্ত্তি’ হিসাবে মান্য হয়। সাধে কি আর ইতিহাসখ্যাত সংস্কারগুরু চাণক্য বলেছেন— ‘চলচ্চিত্তং চলদ্বিত্তং চলদ্জীবনযৌবনং/চলাচলং ইদং সর্বং কীর্তিযস্য স জীবতি’।

সদাপরিবর্ত্তনশীল গতিময় জীবনধারার মধ্যে নিত্যনতুন সৃষ্টির যে সম্ভাবনা তৈরী হয়, স্পষ্টতই ‘গুরু’ চাণক্য তার বদলে কাঠামোসর্ব্বস্ব ‘কীর্ত্তি’কেই স্থায়ী জীবনপ্রতীক হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু কোনো কাঠামোই তো স্থায়ী নয়— কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, সমস্ত কাঠামোই তা সে সজীব হোক কি জড়, ভেতরে ভেতরে ক্রমক্ষয়িষ্ণু, স্থায়ীত্ব এবং নশ্বরতা পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক, তাই মাত্রাতিরিক্ত স্থায়ীত্ব দেওয়ার চেষ্টা প্রায় সমানুপাতিক হারে নশ্বরতার সম্ভাবনাকেও বাড়িয়ে তোলে। এই উপলব্ধি যে প্রাচীন গুরুবাদীদের ছিল না সে কথা ভাবলে ভুল হবে, বরং তা ছিল বলেই তারা ক্রমাগত ‘সংস্কার’ করে সমাজসংসারে স্থায়ীত্বের মিথ্ নির্ম্মাণ করে গেছেন যেখানে কাঠামোটাই সত্য তার ক্রমক্ষয়িষ্ণুতা নয়। অতএব কাঠামো নির্ম্মিত হচ্ছে, তাতে ‘দোষ’ও ধরা পড়ছে সুতরাং ‘দোষাবরণ’ও আবশ্যিক আর যথাবিহিত সংস্কারের গুরুত্বও বজায় থাকছে।

 

  1. ইংরাজী race verb এর অর্থ :- Run in competition against এবং race noun এর অর্থ :- People of common descent/origin. অর্থাৎ প্রতিযোগিতার প্রয়োগ হচ্ছে দল পাকানো, যে বিষয়ে সকলের সমান অধিকার তাতে বিশেষ কোনো দল বা উপদলের অধিকার কায়েম করার বিশেষ উদ্দেশ্যেই। অর্থাৎ, To race to form a race. কিন্তু ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ‘প্রতিযোগিতা’ শুধুমাত্র প্রতিযোগীদের সক্রিয় অংশ গ্রহণকেই বোঝায়। (Competition- Com+petition, where ‘com’ prefix denotes togetherness)
  2. आवरण : Wilson Sanskrit-English Dictionary (2nd Ed. 1832) n. (-णं)i. Covering. ii. A covering, a garment. iii. A shield. iv. An outer bar or a fence, a wall. v. An obstruction. vi. Mental blindness.
  3. In his Minute on Indian Education of February 1835, he asserted, “It is, I believe, no exaggeration to say that all the historical information which has been collected from all the books written in the Sanskrit language is less valuable than what may be found in the most paltry abridgement used at preparatory schools in England”
  4. পৃথক সাদৃশ্য– একই রঙের ভিন্ন ভিন্ন ফুল, পাতা, ফল, পাখী কিংবা একইরকম আকৃতি (গোল, লম্বা, চ্যাপ্টা) বিশিষ্ট আলাদা আলাদা প্রাণী বা জড়বস্তু। যেমন লাল রঙের জবা, শিমূল, পলাশ। কালো রঙের কাক, ময়না, কোকিল। জলচর প্রাণী, স্থলচর প্রানী ইত্যাদি।
    সদৃশ পার্থক্য– ২, ৪, ৬, ৮, ১০………..। দুই হাতের মধ্যেকার পার্থক্য, দুই পায়ের মধ্যেকার পার্থক্য। নর-নারীর মধ্যেকার পার্থক্য, বাঘ-বাঘিনীর মধ্যেকার পার্থক্য।
  5. It should now be clear that all forms of perception-both through the senses and through the mind-involve a cyclic form of activity. Incoming information is apprehended by the mind and, in turn, produces an outgoing activity in which further scanning and information gathering take place in order to confirm, explore, and reinforce what has been seen. This new activity gathers additional information, which is again apprehended by the mind, leading to yet more outgoing activity. But this is very similar to what happens in science as well. Knowledge of reality does not therefore lie in the subject, nor in the object, but in the dynamic flow between them. However, since reality itself is inexhaustible and never fully covered by knowledge, it could also be said to lie outside the subject, while at the same time including this overall cyclic activity. (Science, order and creativity – David Bohm, F. David Peat – Bantam Books 1987,Page 67)
  6. মানবমনে জ্ঞানার্জ্জন ও সঞ্চয়ের প্রাকৃতিক পদ্ধতি চিত্র:
  7. Nature: [uncountable]the way that things happen in the physical world when it is not controlled by people. Nature: [countable, uncountable] the usual way that a person or an animal behaves that is part of their character. (Oxford advanced learner’s dictionary).
  8. To all the different varieties of values in use there correspond as many different kinds of useful labour, classified according to the order, genus, species, and variety to which they belong in the social division of labour. This division of labour is a necessary condition for the production of commodities, but it does not follow, conversely, that the production of commodities is a necessary condition for the division of labour. In the primitive Indian community there is social division of labour, without production of commodities. (Capital A Critique of Political Economy by Karl Marx , Volume One, Book One: The Process of Production of Capital. Part 1 Section 2 page 31.Progress Publishers, Moscow, USSR.)
  9. People who live in glass houses ought not to throw stones. Quite the opposite. They are the very people who should throw stones at others. They ought to keep up such a fusillade of stones that others can’t get near their home. Or, if it means that people who have faults should not talk of others, wrong again! In fact, they should talk about other’s faults so that their faults are not seen. Come on, you’ve done it before!! — Old Proverbs made new – Stephen Leacock

গর্ভাধান, পুংসবন, সীমান্তোন্নয়ন, জাতকর্ম্ম, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ, উপনয়ন, সমাবর্ত্তন ও বিবাহ।

And Adam knew Eve his wife; and she conceived, and bare Cain, and said, I have gotten a man from the LORD. (Genesis 4:1 KJV, The holy bible)

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত প্রবন্ধ, যা কিছু হারায় গিন্নী বলেন, ‘কেষ্টা বেটাই চোর’ — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *