কবিতা মাহবুবুল ইসলামের কবিতা

মুরিদানা

এই পৌষের শীতেই সিদ্ধান্ত
নিলাম
পীরের কাছে মুরিদ হবো।
তাই সবুজ ঘাসের কাছে প্রথম
তালিম নিলাম,
সে বলে ‘আমাদের জীবন হলো
শিশির-হরফে লেখা
একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।
বৃথাই করছ বড়াই, মনু’

আমি দ্বিতীয় মুরিদান নিলাম
পিতার লাঙ্গলের কাছে।
আমরা যখন ইস্কুলে দৌঁড়ি
বিদ্বান হবার লোভে,
আমার পিতা লাঙ্গলের ফলায়
পাঠ করে সভ্যতার আদিম হরফ।
মৃত্তিকার পাললিক শরীর খুঁড়ে
খুঁড়ে গড়ে ভিন্ন এক ব্যাকরণ
নির্মিতি।
আমার পিতামহরা জমির
আইল বাঁধতে বাঁধতে শিক্ষা নিত
বন্ধনও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার কৌশল।
অথচ আমরা শব্দে শব্দে গড়ি
স্বতন্ত্র অহংকার, বিচ্ছেদ।

সর্বশেষ মুরিদান নিলাম
মায়ের তামাটে আঙ্গুলের কাছে।
সংযুক্ত শ্যাওলার পরিবার জানে
প্রতিদিন কলসি ঘাটে
জলের হরফে
তৈরি করে
পারিবারিক সন্ধি—
বিভক্তহীন এক সমাস বদ্ধ পদ।
আমার দীদারা
মাছ কাটতে কাটতে কেটে দিত
জীবনের আয়ু।
মায়ের কাছ থেকে তালিম নিলাম
উৎসর্গের পরিভাষা।

প্রকৃতি দর্শন

মাঝে মাঝে চাঁদটাকেই আমার
সবচেয়ে সাম্যবাদী মনে হয়।
যখন তার কোলেস্টরাল দেহ
ফেটে ঝরে সাদা স্নিগ্ধ
আলো,
ইটের অরণ্যে
কিংবা
জীর্ণ কুটিরে
সমানভাবে
একমাত্র মানুষেরই
এক জীবনে
হাজার গ্রন্থ
পড়েও খুলে না হৃদয়ের
গ্রন্থি।
মাঝে মাঝে বহমান নদীর দিকে
তাকিয়ে বিশ্বায়নের সংজ্ঞা খুঁজে
পাই।
বহু বর্ণের, বহু হরফের নদীগুলো
একসাথে মিশে
সমুদ্রের বুকে তৈরি করে এক
বিভক্তিহীন সমাসবদ্ধ পদ।
অথচ মানুষই প্রত্যেকটা
সম্পর্কের মাঝে টানে বিরামচিহ্ন
দীর্ঘ হাইফেন।
ওই দূর দিগন্তে দ্যাখো
উড়ে যায়।
আর্শ্চয্য মেঘের দল নীল বিষাদ
কেটে কেটে
তাদের নেই তাঁরকাটা সীমান্ত
ভিসা কিংবা পাসপোর্ট।
মাঝে মাঝে ওই অমেরুদণ্ডী
বৃক্ষের কাছেই শিখি প্রকৃত
মনুষ্যত্বের সংজ্ঞা
এক একটা মগ্ন বৃক্ষ যিশুর মতো
প্রচার করে
“প্রার্থনার চেয়ে সেবা কিংবা
বিসর্জন অনেক দামী”

বাঁশি

Heard melodies are sweet, but those unheard are sweeter
— Grecian Urn/ John Keats

একটা বাঁশি যেটা কিনা বাঁশবনে
তার একান্নবর্তী পরিবার ফেলে এসেছে,
এখন সে শুধু একটা মৃত হাড়।
আজ সে মানুষের সমাজে
একাকিত্ব ও বিরহের গান
শোনাতে এসেছে।
কান পেতে শোন,
তার কফিনে জমা আছে
পূর্বজনমের সব দীর্ঘশ্বাস।
ভিতরের ক্ষত বিক্ষত এক একটা
বিরহের সুর লিখে রেখেছে
তার মৃত্যুর এপিটাফ।
মানুষের সব ক্রন্দন, না বলা কথা
সব বিরহ লুকিয়ে আছে
তার শুকনো ত্বকের ভাঁজে। আমাদের ক্রমাগত
অন্তর্দহন যখন কোন পরিভাষা
বিশ্বকোষেও পায় না খুঁজে…
যখন টাইমলাইন জুড়ে চলে
সন্ত্রাসী সব শব্দের উৎপাত
এক একটা ইয়াবা রাত্রি শেষে
মেসেঞ্জারের নীলঘরে পড়ে থাকে
নিকোটিনের ছাই
তখন একটা বাঁশি নদী ভাঙ্গনের
মতো ঢেউ তুলে জানায়
সুরের চেয়ে আদিম
প্রকৃতির কোন ভাষা নেই।
একটা বাঁশির কাছে জেনে নাও
এক জীবনের বনসাই হৃদয়ে
পৌঁছতে
মানুষ কতটা দূরত্ব তৈরি করে।

পাথর দর্শন

একখণ্ড পাথরকে মানুষ প্রশ্ন করে,
তুমি কেন কঠিন পদার্থে গড়া?
পাথর উত্তর দেয়, আমরা তো ভিতর বাহির একই ধাতুতে ভরা।
মানুষ, তোমার
নরম ত্বকের ভিতর কোনো কঠিন পদার্থ ভরা?

বৃক্ষরোপন

বৃক্ষের প্রসঙ্গ এলেই
আমাদের ভোগবাদী মানুষের মনে
বৃক্ষের তৈরি রকমারি ফার্নিচারের ছবি
বেশি ভাসে।
যে বৃক্ষের ডালে একদা পাখিদের পরিবার
বাস করতো।
সেই বৃক্ষের তৈরি সুন্দর
ফার্নিচারে বসে, আনন্দে
এখন পুরো পরিবার
ডিসকভারিতে পশু, পাখির
শিকার দেখি।

প্রেম

Our sweetest songs are those that tell of saddest thoughts
— P.B. Shelley

প্রেমে ডুবে থাকা ভালো
প্রেমে বিচ্ছেদ, বিরহ আরো ভালো,
কবি বলেন—
এটা প্রাচ্যের আয়ুর্বেদিক ঔষধ
এ দাওয়ায় অমর হয়েছে দেবদাস
প্রতিটি প্রেমে বিচ্ছেদ
আদমের গন্ধম খাওয়ার মতো
মানুষকে মৌলিক হতে শেখায়।
পৃথিবীর প্রত্যেক বিরহের
প্রেমিকরা জানে
কারো কারো চোখের নিচে
কালো রেখাটা ম্যালানিন নয়,
কয়েকটা বরফ
শীতল রাত অন্ধকার হয়ে লেগে
আছে চোখের কোণে।
ওই বহতা নদীর দিকে তাকাও
সেও জানে
তার দুই তীর মিশে গিলে
জলের অস্তিত্ব¡ হারায়, প্রেমও বয়ে চলে
বিরহে
বিচ্ছেদে
ওই বহতা নদীর মতো।
এতএব প্রেমে ডুবে থাকা ভালো
প্রেমে বিরহ বিচ্ছেদ আরো ভালো।

সেপিয়েন্স

জিনের সূত্র ধরে আমরা সবাই
মিছিল ফেরত প্রাইমেটদের আলফা পুরুষ।
জলে, বৃক্ষে কিংবা নক্ষত্রের
ধূলিকনায়
ফেলে এসেছি অস্তিত্বের ফসিল।
একদা মৃত্তিকা ও জলের সংগমে
জন্মেছিল যে পৌরাণিক পাখি,
আমরা তারই এক বিষণ্ন ও ক্লান্ত
মেটামরফসিস—
নাম হোমো সেপিয়েন্স।
নিয়ান্ডারথাল অন্ধকার
গুহা থেকে আলোর কোয়ান্টাম যুগে
এসেও জেনেছি—
অনন্ত বিষাদ ও বিষণ্নতা
ছাড়া
মানুষের আর কোন সমার্থক বা
বিপরীত শব্দ নেই।

পিঁপড়া বিদ্যা

তখনও পৃথিবী এতোটা সভ্য ও
শিক্ষিত হয়নি।
তখনও মানুষেরা একসংগে
মেঠোপথেই হাঁটতো।
পিঁপড়ারা তখনও দলবদ্ধভাবে
চলত।
এখন মানুষ সভ্য ও শিক্ষিত
হয়েছে।
মেঠোপথ বিভক্ত হয়ে
সড়ক, মহাসাগর, ফ্লাইওভার—
এখন মানুষের সামনে বহু অপশন।
দলে, মতে, বর্ণে, আদর্শে বহু
বিভক্ত।
অথচ মানুষ তার গন্তব্যে পৌঁছার
সঠিক পথটাই খুঁজে পাচ্ছে না।
স্বল্পবুদ্ধির পিঁপড়ারা এখনও
দলবদ্ধভাবে চলছে।

আয়না দর্শন

আমাদের ঘরের আসবাবপত্রের মাঝে
আর যাই হোক
আয়নাটা সবচেয়ে ঝকঝকে থাকে।
কারণ, মানুষ তার নিজের
ইমেইজটা কখনও খারাপ দেখতে
চায় না।
অন্য মানুষের ভালো কাজের চেয়ে
খারাপ কাজ বা স্ক্যান্ডালের সংবাদ
দ্রুত কানে আসে।
কারণ,
মানুষ কখনো অন্যের
ইমেইজটা ভালো দেখতে
চায় না।

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত কবিতা, মাহবুবুল ইসলামের কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *