[শত শত বছর ধরে সুফী সাধকরা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে ছোট ছোট গল্প ব্যবহার করতেন। অল্প কথায় সহজ ভাষায় সুফী সাধকরা তাদের অর্জ্জিত জ্ঞান ও উপলব্ধির কথা জানাতে পারতেন যা হাযার হাযার পৃষ্ঠার বর্ণনায়ও হয়ত দুঃসাধ্য। আমার সংগ্রহের সেইসব জ্ঞান ও উপলব্ধির কয়েকটি এখানে আপনাদের কাছে হাজির করছি।]
১.
রাবিয়া, প্রথিতযশা এক সুফী সাধক। যাঁর কথা সকলেরই জানা…। সেদিন তিনি বাজারের পথে যাচ্ছিলেন।
প্রতিদিন তিনি একই রাস্তায় বাজারের পথে যেতেন, চিৎকার করে জানান দিতেন যে সত্য তিনি অর্জ্জন করেছিলেন। তিনি লক্ষ্য করে দেখতেন দীর্ঘদিন ধরে একটা মসজিদের দরযার সামনে বসে আছেন এক মরমী সাধক হাসান। তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছেন, “দরযাটা খুলুন! অনুগ্রহ করে দরযাটা খুলুন! আমাকে ঢুকতে দিন!”
সেদিন আর রাবিয়া তা সহ্য করতে পারেননি। হাসান কাঁদছিলেন অঝোরে, দু’চোখ বেয়ে তার অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। হাসান বারবার চেঁচিয়ে বলছিলেন, “দরযা খুলে দিন! আমাকে ঢুকতে দিন! কেন কেউ শুনছিল না? ঈশ্বর, আপনি আমার প্রার্থনা শুনছেন না কেন?”
রাবিয়া প্রতিদিন হাসতেন। যখনই হাসানের কান্না শুনতেন, তিনি হাসতেন। কিন্তু সেদিন হাসানের কান্না ছিল প্রবল। হৃদয় বিদারক। রাবিয়া হাসানের কাছে এগিয়ে গেলেন, তার কাঁধ প্রবলভাবে ঝঁকিয়ে বললেন, “এই সমস্ত বাজে কথা বন্ধ করুন! দরযা খোলাই আছে— আর ইতোমধ্যে আপনি তাতে প্রবেশ করেছেন!”
হাসান রাবিয়ার দিকে তাকালেন। তার চোখে চোখ রাখলেন। তারপর রাবিয়ার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে মাথা নীচু করে পা ছুঁয়ে বললেন, “তুমি ঠিক সময়ে এসেছ; নইলে আমি আমার সারাজীবন তাঁকে ডাকতাম! বছরের পর বছর ধরে আমি তাই করেছি— এতদিন তুমি কোথায় ছিলে? আমি জানি প্রতিদিন তুমি এই রাস্তাটা পেরিয়ে যাও। নিশ্চয়ই প্রতিদিন আমাকে কাঁদতে, প্রার্থনা করতে দেখেছ”
রাবিয়া বললেন, “হ্যাঁ, তবে সত্য একটা নির্দ্দিষ্ট জায়গায়, একটা নির্দ্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, নির্দ্দিষ্ট মুহূর্ত্তেই বলা যায়। আমি সেই সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম। আজ সেই সময় এসেছে; তাই আমি এসেছি। যদি আমি গতকাল আসতাম, আপনি বিরক্ত হতেন; রাগ করতেন। আপনার মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হত। আপনি হয়ত বলতেন, “তুমি আমার প্রার্থনা বিঘ্নিত করেছ!’ আমি আপনার প্রার্থনা বিঘ্নিত করতে চাইনি।”
এমনকি একজন বাদশাহর-ও কোন ভিক্ষুকের প্রার্থনায় বিঘ্ন ঘটানোর অধিকার নেই। কোন খুনী, কোন অপরাধীকে প্রার্থনারত অবস্থায় আটক করা যায় না। তার প্রার্থনা শেষ না হওয়া পর্য্যন্ত কোতোয়ালকে অপেক্ষা করতে হয়, প্রার্থনা শেষ করার পর-ই আটক করা যায়। প্রার্থনারত আবস্থায় কাউকে বিরক্ত করা উচিৎ নয়।
রাবিয়া বললেন, “আমি এখন আপনাকে বলছি, “হাসান, বোকামি করবেন না, দরযা খোলাই আছে— আর আপনি ইতিমধ্যে তা অতিক্রম করেছেন!” “তবে কথাটা বলার জন্য আমাকে সঠিক মুহুর্ত্তের অপেক্ষা করতে হয়েছে”।
২.
সুফী সাধকরা দাবী করেন, তাঁদের মৃত্যু নেই। তাই তাদের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয় অনেকটা বিবাহ অনুষ্ঠানের মত আয়োজন করে। আমরা এই সুফী সাধকদের মৃত্যুবার্ষিকী পালনের আয়োজনকে ‘উরস’ বা ‘ওরস’ হিসেবে জানি।
আরবিতে ‘উরস’ বা ‘ওরস’ শব্দের অর্থ বিবাহ।
সুফী সাধকদের বিশ্বাস মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিবাহ সম্পন্নের পর তারা ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ করেন। মৃত্যু হল ঈশ্বরের প্রতি তাদের ভালবাসার পরিণতি।
সুফীদের সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ সুবিদিত। ভারতবর্ষে বরযাত্রার সময় গান-বাজনা ঐতিহ্যবাহী রীতি। সুফী সাধকদের উরসে গান-বাজনা তারই ধারাবাহিকতা।
নিজাম-উদ-দ্বীন আউলিয়া তাঁর ওয়াসিয়তনামায় (অন্তিম ইচ্ছায়) লিখে গিয়েছিলেন যেন তাঁর জানাজায় সঙ্গীতের আয়োজন করা হয়। শারিয়তপন্থী মুসলিমদের কাছে নিজাম-উদ-দ্বীন আউলিয়ার অন্তিম ইচ্ছা তাদের ধন্দে ফেলে দিয়েছিল।
নিজাম-উদ-দ্বীন আউলিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ শিষ্য গুরুর ইচ্ছাকে অমান্য করার সিদ্ধান্ত নেন। শেষাবধী নিজাম-উদ-দ্বীন আউলিয়ার জানাজাযাত্রা হয়েছিল নিরবেই। নিজাম-উদ-দ্বীন আউলিয়ার জানাজার যাত্রা তাঁর অন্তিম ইচ্ছানুসারে হলে তা সুফীদের জন্য অনন্য এক ঘটনা হত।
নিজাম-উদ-দ্বীন আউলিয়ার জানাজাযাত্রায় তাঁর অন্তিম ইচ্ছা পালন করা হয়নি। যদিও সুফী গায়করা যাহা গেয়ে থাকেন তা ইসলামবিরোধী নয়। তাঁদের কন্ঠে ঈশ্বরের বার্ত্তাই প্রতিধ্বনিত হয়।
৩.
এক সুফী সাধককে একজন ভক্ত জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে সুফী, আপনার গুরু কে?’
সুফী বললেন ‘অনেক দেরী হয়ে গেছে। অল্প সময়ের মধ্যে আমি মারা যাচ্ছি। ভক্ত নাছোড়, সুফী সাধককে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কেবল নামটা বলুন। আপনি এখনও জীবিত, আপনি এখনও কথা বলছেন, আপনি কেবল আমাকে নামটা বলুন।”
সুফী বললেন, ‘এটা বলা খুব কঠিন হবে, কারণ আমার হাযার হাযার গুরু ছিলেন। আমি যদি কেবল তাদের নাম বলতে শুরু করি, মাস নয় বছর লেগে যাবে। অনেক দেরী হয়ে গেছে। তবে তিনজন গুরুর কথা আমি আপনাকে বলে যাচ্ছি।
‘তাদের মধ্যে একজন ছিলেন চোর। একবার আমি মরুভূমিতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। যখন আমি একটা গ্রামে পৌঁছুলাম তখন অনেক রাত। দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। সরাইখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তায় কেউ নেই। আমি কাউকে জিজ্ঞাসা করার জন্য খুঁজছি। শেষে একজনকে পেলাম যিনি একটা বাড়ীর দেয়ালে গর্ত খুঁড়ছিলেন। আমি তাকে কোথায় থাকতে পারি জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেন, “আমি একজন চোর, আপনি দেখতে সুফী সাধককের মত।” একটু থেমে সেই চোরটি আবার বলল, “এখন থাকার জায়গা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন হবে, তবে আপনি আমার বাড়িতে থাকতে পারেন। যদি একজন চোরের সাথে থাকতে আপনার কোনো অসুবিধা না হয়।”
সুফী বললেন, ‘আমি খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেলাম। ভাবলাম একজন চোর যদি কোন সূফিকে ভয় না পায় তবে সুফী কেন চোরকে ভয় পাবে? আসলে তো চোরের আমাকে ভয় পাওয়া উচিৎ। আমি তাকে বললাম, “অমি তোমার সাথে থাকব”। আমি সে রাতে চোরের সাথে থাকলাম। সেই চোরটি এত চমৎকার, এত অমায়িক মানুষ ছিল যে, আমি তার সান্নিধ্যে প্রায় একমাস কাটালাম। প্রতি রাতে সে আমাকে বলে যেত, “আমি আমার কাজে যাচ্ছি। আপনি বিশ্রাম নিতে পারেন, প্রার্থনা করতে পারেন, আপনার যা ইচ্ছে হয় করুন। যখন সে ফিরে আসত আমি তার কাছে জানতে চাইতাম, “আপনি কি আজ কিছু পেয়েছেন?” সে বলত, “আজ রাতে কিছু পাইনি। তবে আগামীকাল আবার চেষ্টা করব। ” কক্ষণো সে নিরাশা ব্যক্ত করত না।
‘একটানা এক মাস খালি হাতে ফেরার পরো সে নাখোশ ছিল না। শেষবারো সে আামাকে বলেছিল, “আমি আগামীকাল আবার চেষ্টা করব। ঈশ্বরের ইচ্ছে হলে হয় ত আগামীকাল কিছু পেয়ে যাব। আপনি আমার জন্য প্রার্থনা করবেন। অন্তত আপনি ঈশ্বরকে বলতে পারেন, “এই দরিদ্র ব্যাক্তিটিকে সাহায্য করুন।”
সুফী বলছিলেন, ‘আমি যখন বছরের পর বছর ধরে ধ্যান এবং সাধনা করছিলাম, তখন কিছুই পাইনি, অনেক হতাশ হয়েছি। এমন মুহুর্ত্ত এসেছিল যখন আমি সমস্ত সাধনা বন্ধ করার চিন্তা করেছি। ভেবেছি কোন ঈশ্বর নেই। আমার সমস্ত প্রার্থনা কেবলই উন্মাদনা। আমার সমস্ত ধ্যান মিথ্যা— তখনই আমি সেই চোরের কথা স্মরণ করতাম যে প্রতি রাতে বলতে, “ঈশ্বরের ইচ্ছে হলে হয়ত আগামীকাল কিছু পেয়ে যাব।”
‘তাই সে আরো একদিন চেষ্টা করত। একজন চোর যদি এতখানি আশাবাদী হতে পারে, এতখানি বিশ্বাসের সাথে আরও অন্তত একদিন আরো চেষ্টা করার আশাবাদ ধরে রাখতে পারে। আমি কেন পারব না? আমার জীবনে এমন অনেকবার ঘটেছে সেই চোরের স্মৃতি আমাকে আরো একদিন আমার সাধনা জারি রাখতে উদ্বুদ্ধ করে। সত্যি একদিন আমি আমার সাধনার ফল পেয়েছি! আমি সেই চোরের গ্রাম থেকে তখন কয়েক হাযার মাইল দূরে ছিলাম। কিন্তু বহুদূর থেকেই আমি সেই চোরটির কাছে নতজানু হয়েছিলাম। সে ছিল আমার প্রথম গুরু।
‘আমার দ্বিতীয় গুরু ছিল একটা কুকুর। আমি তৃষ্ণার্ত ছিলাম। একটা নদীর দিকে যাচ্ছিলাম। তখন একটা কুকুরকে দেখলাম। সেও তৃষ্ণার্ত ছিল। কিন্তু নদীর কাছে গিয়ে পাণিতে নিজেকে দেখে আরেকটি কুকুর ভেবে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। ভয় পেয়ে সে যখন ঘেউ ঘেউ করছিল তখন পাণির কুকুরটিও ঘেউ ঘেউ করছিল। তবে সে এতটাই তৃষ্ণার্ত ছিল যে ফিরে যেতে পারছিল না। সে বারবার নদীর কাছে ফিরে অসছিল, বারবার সে একই কুকুরকে দেখতে পাচ্ছিল। অবশেষে ককুরটার তৃষ্ণা এতটাই তীব্র হয়ে ওঠেছিল যে সে একসময় পাণিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল আর সাথে সাথে কুকুরটিা ছায়া অদৃশ্য হয়ে গেল। সে পাণি খেল, প্রচণ্ড গরম থেকে নিজেকে শান্তি দিতে পাণিতে সাঁতার কাটল। আর আমি কুকুরের গোটা কর্ম্মকাণ্ড দেখলাম। আমি বুঝতে পারলাম ঈশ্বরের কাছ থেকে আমার কাছে একটা বার্ত্তা এসেছে। সকল ভয়কে জয় করে কাঙ্খিত লক্ষ্যের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।’
‘আমি তক্ষণ এক অজানা লক্ষ্যের দিকে ঝাঁপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমাকেও তাড়া করছিল অজানা ভয়। আমাকে এক ভয়াল প্রান্তে যেতে হবে এবং ফিরে আসতে হবে। আমি কুকুরটার কথা স্মরণ করলাম। যদি সেই কুকুরটা অজানা ভয়কে জয় করতে পারে তবে আমি কেন পারব না? তারপর একদিন আমি অজানা লক্ষ্যের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমি অদৃশ্য হয়ে গেলাম এবং কেবল অচেনা কিছু পিছনে পড়ে রইল। কুকুরটা ছিল আমার দ্বিতীয় গুরু।’
‘আমার তৃতীয় গুরু ছিল এটি ছোট্ট বাচ্চা। আমি এক অজানা সহরে প্রবেশ করলাম। দেখলাম একটা ছোট্ট বাচ্চা তার হাতের মধ্যে একটা জলন্ত মোমবাতি লুকিয়ে মসজিদে রাখার জন্য যাচ্ছিল। মোমবাতিটা তার হাতের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল। আমি ঠাট্টা করেই বাচ্চাটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি নিজেই মোমবাতিটা জ্বালিয়েছ?” সে বলল, “হ্যাঁ জনাব।” আমি আবার ঠাট্টাচ্ছলে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কি আমাকে বলতে পার কোথা থেকে আলো এসেছে? একসময় মোমবাতিটা প্রজ্বলিত ছিল না, পরে তুমি মোমবাতিটা জ্বালালে, তুমি কি আমাকে আলোর উৎসটি দেখাতে পার, যেখান থেকে আলো এসেছিল? তুমি যেহেতু আলো জ্বলিয়েছে, তাই তুমি অবশ্যই বলতে পারবে কোত্থেকে আলো এসেছে? “বাচ্চাটা হেসে হাত সরিয়ে ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিল, “আপনি কি এখন দেখতে পেয়েছেন, আলোটি কোথায় গেল? বলুন আমাকে!” তক্ষণি আমার সব অহঙ্কার ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল, এবং আমার সকল জ্ঞান ধুলিস্মাৎ হয়ে গেল। মুহুর্ত্তে আমি নিজের নির্বুদ্ধিতা অনুভব করলাম। তারপর থেকে আমি আমার সকল জ্ঞানকে শূন্য বলে উপলব্ধি করতে শুরু করলাম।’
৪.
গল্পটি আজমিরের… সাধক মঈনুদ্দীন চিশতীর কথা আমাদের জানা। যার দরগাহ আজমীরে।
সাধক চিশতী একজন একজন সঙ্গীতজ্ঞ-ও ছিলেন। সঙ্গীতকে অনেকে ইসলাম বিরোধী বলে থাকেন। কিন্তু সাধক চিশতী সেতারসহ নানান বাদ্যযন্ত্র দক্ষতার সাথে বাজাতে পারতেন। কন্ঠ সঙ্গীত শিল্পী হিসেবেও তিনি ছিলেন দুর্দ্দান্ত। প্রতিদিন অন্তত পাঁচবার প্রার্থনার মতো নিমগ্নতায় তিনি তাঁর গান-বাজনার উপকরণগুলোর সাথে সময় কাটাতেন।
ধর্ম্মবিরোধী এ কাজ নিয়ে সাধক চিশতীকে কেউ কখনও কিছু বলতে পারেনি। যারা তাঁকে সঙ্গীত বিরোধী কথা বলার জন্য আসত তিনি তাদের গান শোনাতেন। তাঁর গান শুনে তারা বিমোহিত হয়ে যেত। বেমালুম ভুলে যেত কেন তারা চিশতীর দরবারে এসেছে। মৌলভী সহেবরাও চিশতীর গানবাজনা নিয়ে আপত্তি জানাতে এসে ভুলে যেতেন, কেন তারা এসেছেন। কোন ওজর-আপত্তি না জানিয়েই তারা ফিরে যেতেন। ফিরে গিয়ে তাদের মনে পড়ত কেন তারা এসেছিলেন।
চিশতীর খ্যাতি তখন ছড়িয়ে পড়েছিল। দূর-দূরান্ত থেকে লোকেরা তাঁর কাছে আসত। একবার বাগদাদ থেকে চিশতীকে দেখতে এসেছিলেন জিলানী নামের আরেক সাধক। মঈনুদ্দিন চিশতী যখন শুনলেন বাগদাদ থেকে জিলানী আসছেন, তখন চিশতী জিলানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বাদ্যযন্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখলেন। ভাবলেন জিলানীর সম্মানে বাদ্যযন্ত্র বাজানো অনুচিৎ হবে। তিনি যেমন একটা গোঁড়া মুসলমান, এতে তিনি আহত হতে পারেন। তাঁর পুরো জীবনে তাই কেবলমাত্র একদিনের জন্য তিনি, বাদ্যযন্ত্র বাজাবেন না, গান গাইবেন না। তিনি সকাল থেকে অপেক্ষা করলেন এবং বিকেলে জিলানী এলেন। চিশতী তার যন্ত্রাদি লুকিয়ে রেখেছিলেন।
জিলানী আজমীরে চিশতীর আস্তানায় তশরীফ আনলেন। তারপর তারা দুজনেই নীরবে পরস্পরের মুখোমুখী বসলেন। দুই সাধকের তখন নীরব সাক্ষাৎপর্ব্ব চলছে। অকস্মাৎ তাদের নীরবতা ভেঙ্গে বাদ্যযন্ত্রগুলি সুর করে বেজে ওঠল— পুরা ঘরটা সুরের গুঞ্জনে গুঞ্জরিত হয়ে ওঠল। চিশতী কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। তিনি তো সেগুলি লুকিয়ে রেখেছিলেন, এরকম অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে তিনি তা ভাবতেও পরেননি। জিলানী মুচকি হেসে বললেন, “বিধান আপনার পক্ষে নয়, আপনার এগুলি গোপন করার দরকার নেই। বিধিগুলি সাধারণ মানুষের জন্য, বিধিগুলি আপনার জন্যে নয়— আপনার এগুলি গোপন করা উচিৎ নয়। আপনি কীভাবে আপনার আত্মাকে আড়াল করতে পারেন? আপনার হাত না বাজতে পারে, আপনি গলা থেকে গান নাও গাইতে পারেন, তবে আপনার পুরা সত্তাই তো বাদ্যযন্ত্র। আপনার পুরা ঘরটা এত বেশী সঙ্গীতে পরিপূর্ণ যে তারা নিজেই বেজে ওঠেছে।”
৫.
এক দারবিশ তাঁর এলকায় সর্ব্বজনগ্রাহ্য পবিত্র ব্যাক্তি হিসেবে সম্মানিত হতেন। কিন্তু যখনই তাকে জিজ্ঞাসা করা হত কেমন করে এত পবিত্র হয়ে উঠলেন, তিনি নির্ব্বিকার উত্তর দিতেন, ‘আমি জানি কোরানে কী আছে’।
একদিন এক অনুসন্ধিৎসু তাঁকে চা-খানায় পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, কোরানে কী আছে?’ সেই দারবিশ গম্ভীর স্বরে জবাব দিলেন, ‘কোরানে! দুটো চ্যাপ্টা ফুল আর আমার বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া একটা চিঠি রয়েছে’।
৬.
শায়েখ নিজামুদ্দিন আউলিয়া একদিন তাঁর মুর্শিদের ঘরে প্রবেশ করলেন। তিনি তাঁর কাছে নিজের বিশ্বাসে অবিচল থাকার প্রার্থনার জন্য অনুরোধ করলেন। বাবা ফরিদ এই অনুরোধ রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেন। পরে তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, কেন তিনি বাবা ফরিদকে সুফী সঙ্গীত শুনতে শুনতে মৃত্যুর প্রার্থনা করার জন্য অনুরোধ করেননি।
৭.
একজন ব্যাক্তির দারবিশদের সম্পর্কে ধারণা ছিল, তারা কখনই মাংস স্পর্শ এবং ধূমপান করেন না। বিষয়টি তাকে আকৃষ্ট করে। এই ব্যাক্তি আলোকিত দারবিশদের শরণাপন্ন হতে পাড়ি জমান জাওয়াইয়ার দিকে। যেখানে দারবিশরা একত্রিত হতেন। তারা সকলেই ছিলেন প্রায় নব্বই ঊর্ধ্ব বয়সী।
সত্যিই সেখানে নিকোটিন বা প্রাণীজ প্রোটিনের দেখা মেলা ছিল দুষ্কর। সেই ব্যাক্তিটা উল্লসিত হলেন। খোলা হাওয়ায় পান করলেন সুস্বাদু পানীয় এবং সবজির স্যুপ খেলেন আনন্দচিত্তে। মনে মনে বিশ্বাস করতে শুরু করলেন এখানে তিনি কমপক্ষে একশত বছর বাঁচবেন।
এরই মধ্যে ফিসফিস করে একজন বললেন, ‘অমাদের মহান শিক্ষক অসছেন’! “শ্রদ্ধেয় মহর্ষি আসার সাথে সাথে সকলেই উঠে দাঁড়াল। স্মিত হাসিমুখে তিনি তাঁর কক্ষের দিকে চলে গেলেন।
ব্যাক্তিটা জিজ্ঞেস করলন, ‘তার বয়স কত, এবং তিনি কী খান?’ আগত দর্শনার্থীর উদ্দেশ্যে একজন দারবিশ বললেন, ‘তাঁর বয়স একশত পঞ্চাশ এবং আমি মনে করি না যে আমাদের মধ্যে কেউ এই শ্রদ্ধাস্পদ বয়সে পৌঁছুতে পারবে।’
তবে সেজন্য তাকে অবশ্যই দিনে বিশটা সিগার এবং তিন টুকরা মাংসখণ্ডের বেশী দেয়া হবে না, যেহেতু তিনি এখন সকল প্রলোভনের ঊর্ধ্বে!’
৮.
সূর্য্য একদিন এক গুহার সাথে কথা কৈতে গেল। সমস্যা ছিল দু’জনারই।
সূর্য্য কক্ষণো অন্ধকার এবং আর্দ্রতার মধ্যে থাকার সুযোগ পায়নি। গুহাও অতৃপ্ত ছিল সে কক্ষণো আলোকময়তা এবং নির্ম্মলতার পরিচয় পায়নি।
দুজনাই সিদ্ধান্ত নিল অবস্থান বদলের। গুহাটা চলে গেল সূর্য্যের অবস্থানে, সূর্য্য নেমে এল অন্ধকার-আর্দ্র গুহায়।
সূর্য্যের অবস্থানে পৌঁছে গুহাটা বলল, ‘আমি ত এই আলোকময়তা এবং নির্ম্মলতার মাঝে কোন চমৎকারিত্ব খুঁজে পাচ্ছি না। আমি ফিরে যেতে চাই আমার সেই অন্ধকার-আর্দ্র গুহায়।
সূর্য্যও গুহায় নেমে গিয়ে বলল, ‘আমিও আলোকময়তা এবং নির্ম্মলতার সাথে অন্ধকার এবং আর্দ্রতার কোন তফাৎ খুঁজে পাচ্ছি না।
৯.
একটা ব্যাঙের দল জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তাদের মধ্যে দুটো ব্যাঙ গভীর গর্তে পড়ে গেল। অন্য ব্যাঙগুলো গর্তের চারদিকে জড় হয়ে দেখতে পেল গর্তটা বেশ গভীর। ব্যাঙ দুটার জন্য তারা খুব দুঃখ পেল। বলল, দুর্ভাগ্যজনক হলেও মেনে নিতে হবে তোমরা আর কক্ষণোই এ’খান থেকে বেরুতে পারবে না।
গর্তে পড়া ব্যাঙ দু্ইটা ওপরের সঙ্গীদের মন্তব্য উপেক্ষা করে গর্ত থেকে উঠার চেষ্টা করতে থাকল। সঙ্গীরা বারবার নিষেধ করতে থাকল। বলল, তোমরা এ গর্তেই থাক। ওদের কথায় মনোযোগ দিতে গিয়ে গর্ত থেকে লাফিয়ে ওঠার এক পর্য্যায়ে একটা ব্যাঙ পড়ে গিয়ে মারা গেল।
অন্য ব্যাঙটা তখনো সাধ্যমত গর্ত থেকে লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। ওপরের ব্যাঙগুলো কক্ষণো তারস্বরে চিৎকার করছিল, এ গর্ত থেকে বেরুনোর চেষ্টা বন্ধ কর। কিন্তু ব্যঙটা তাদের কারো কথা না শুনে জোরে লাফ দিল। শেষপর্য্যন্ত সে গর্ত থেকে বেরিয়ে এল।
গর্তের উপর বেরিয়ে আসার পর সঙ্গী ব্যাঙগুলো তার কাছে জানতে চাইল, আমাদের কথা না শুনে তুমি কেন এতো জোরে লাফ দিলে? উদ্ধার পাওয়া ব্যাঙটা বলল, আমি কানে কম শুনতে পাই। তাই ভেবেছি তোমরা আমাকে জোরে লাফিয়ে ওঠার জন্য উৎসাহিত করছিলে।
সুফিকণিকার সকলপর্ব্ব
আরশাদ সিদ্দিকী রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গল্প, সুফিকণিকা : পর্ব্ব এক — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।