পর্ব্ব— ১
মাঝেমধ্যে শিল্প ও সাহিত্যের ভাল-মন্দ আলোচনা-সমালোচনা পড়ি বড় কাগজে, ছোট কাগজে। কিন্তু এটাও বুঝি আমাদের শিল্প-সাহিত্যকে ঘিরে সমালোচনা-সাহিত্য এখনো গড়ে ওঠেনি। কখনো খুবই ভাল সমালোচনা দেখতে পাই লিটল-ম্যাগগুলোতে, আর যা ছাপা হয় তাকে কী যে বলি বুঝতে পারি না। ওই সব পত্রিকার সমালোচকরা কবিতা নিয়ে লেখেন, কবিতার কাব্যভাষা চমৎকার … কবি জীবনকে তার নিখুঁত শব্দ দিয়ে তুলে এনেছেন … কবিতার ছন্দগুণ অপূর্ব্ব … বইটির প্রচ্ছদ ও বাঁধাই ভাল … দাম একশত টাকা’। গল্প-উপন্যাস নিয়ে সমালোচনা ছাপা হয়, ঘটনার বিন্যাস আমাদের নিয়ে যায় এক জাদু-বাস্তবতার বিশ্বে … লেখক তার চরিত্র-চিত্রণে অসম্ভব দক্ষতা দেখিয়েছেন … বইটির ভাষা আরো প্রাঞ্জল হতে পারত … প্রচ্ছদ ও বাঁধাই ভাল … দাম দুইশত টাকা’। আমাদের কবি, সাহিত্যিক আর সমালোচকরা সাহিত্য ও সমালোচনা তত্ত্ব না জানার ফলেই এমন ঘটনা ঘটে বলে আমার বিশ্বাস। আজ তাই নতুন সমালোচনা তত্ত্ব নিয়ে কিছু লিখলাম, আগামীতে অন্যান্য তত্ত্ব নিয়ে লিখব।
নতুন সমালোচনা তত্ত্ব :
ধ্রুপদী সমালোচনায় একজন সমালোচক পাঠের বাইরে গিয়ে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে অনেক বাগবিস্তার করতে পারতেন। আমাদের ছেলেবেলায় বাংলা পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে দু-চার লাইন কবিতা ছেপে আমাদের ব্যাখ্যা করতে বলা হত। ওইসব কবিতার ব্যাখ্যা লিখতে গিয়ে আমরা লিখতাম—
‘‘এই কবিতার লাইনগুলো ‘অমুক’ কবির ‘অমুক’ কবিতা হইতে উপস্থাপন করা হইয়াছে। কবিতার এই পঙ্ক্তিতে কবি বলিতে চাহিয়াছেন যে … ইত্যাদি ইত্যাদি।’’ কিছু যুক্তিসহ মনের মাধুরী মিশিয়ে যে যত বেশী লিখতে পারত সেই পেত সবচেয়ে বেশী নম্বর। ধ্রুপদী সমালোচনার সুবিধা ছিল এই যে, আমরা কবির চিন্তাকে কল্পনা করে আমাদের চিন্তা-চেতনাকে উপস্থাপন করতে পারতাম খেয়াল-খুশিমত।
১৯২০ সালের শেষ থেকে ‘নতুন সমালোচনা তত্ত্বের শুরু এবং ১৯৩০-এর দশকে তা মোটামুটি গ্রহণযোগ্যতা পায়। ধ্রুপদী সমালোচনায় পাঠের বাইরে গিয়ে বাগবিস্তার করার সুযোগ থাকত কিন্তু নতুন সমালোচনায় এ সুযোগটা আর রইল না। ভাষাসৃষ্ট সাহিত্যের সার্ব্বভৌমত্ব স্বীকার করলেন নতুন— সমালোচকবৃন্দ এবং তারা বললেন, কোন সাহিত্য কর্ম্মকে বিচার ও বিশ্লেষণ করার সময় মূল পাঠ থেকে বেরিয়ে অন্য কোন প্রসঙ্গকে আনা বাঞ্ছনীয় নয়। একটি কবিতা, গল্প, উপন্যাস বা নাটক রচনার সময় একজন কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক বা নাট্যকারের চিন্তা-চেতনায় কী ছিল, তা আবিষ্কার করার চেষ্টা না করে সাহিত্যকর্ম্মটির পাঠকেই আলোচনা-সমালোচনায় সীমাবদ্ধ রাখা উচিৎ।
পর্ব্ব— ২
কাঠামোবাদী সাহিত্যতত্ত্ব :
ষাটের দশকের প্রথমদিকে কাঠামোবাদী সাহিত্যতত্ত্বের উদ্ভব হলেও ১৯৮০ সাল নাগাদও তত্ত্বটি নতুন সাহিত্যদর্শন হিসেবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করে। কাঠামোবাদী সাহিত্যতাত্ত্বিক রোলাঁ বার্থ বলেন যে, একজন লেখক ইতোমধ্যেই লেখা হয়েছে এমন সব সাহিত্যকর্ম্ম থেকে ধারণা/বর্ণনা/বক্তব্য/উপাদান নিয়েই কোন এক নতুন বিন্যাসে তার নতুন সাহিত্যকর্ম্মটি রচনা করেন এবং লেখার মাধ্যমে একজন লেখক কোন অবস্থাতেই নিজেকে প্রকাশ করেন না, বরং সমাজ ও সভ্যতার মাঝে অবস্থানকারী ভাষা ব্যবস্থা থেকে উপকরণ নিয়ে কিছু বিষয়কে উপস্থাপন করেন মাত্র।
কাঠামোবাদী সাহিত্যতত্ত্বের প্রেক্ষাপটে প্রচ্ছন্নভাবে সস্যুরের ভাষা-অর্থতত্ত্ব কাজ করেছে, কারণ সস্যুরই প্রথম ভাষার অর্থ-উদ্ধার প্রক্রিয়ায় ভাষা-অর্থ কাঠামোকে উপস্থাপন করেছিলেন। কাঠামোবাদী সাহিত্যতাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করেন যে, মানুষের কোন কাজই প্রাকৃতিক কিংবা সহজাত নয়, বরং জীবনের প্রয়োজনেই তা মানব-সৃষ্ট। মানুষ যেহেতু তার প্রয়োজনেই ভাষা-সৃষ্ট কর্ম্ম-কাঠামো সৃষ্টি করেছে এবং ভাষার সাহায্যেই সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণ করেছে তার চেতনা ও চৈতন্যকে, সেহেতু যে- কোন সাহিত্যকর্ম্মও আসলে মানুষের সৃষ্টি করা কর্ম্ম ও চিন্তার কাঠামোর প্রতিফলন। একজন ভাষা-শিল্পী তার সৃষ্টিকে সামাজিক ও পার্থিব ভাষা-কাঠামোকে গ্রাহ্য করেই রচনা/গ্রন্থনা করেন, যা always alredy written এবং একটি সাহিত্য-সৃষ্টি স্রষ্টার সাথে কোন সম্পর্ক না রেখেই সার্ব্বভৌম।
সাহিত্য যে মানুষের ভাষা-কাঠামোকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় তা আমরা বিশ্বসাহিত্যকে বিশ্লেষণ করেও বুঝতে পারি। রূপকথার রাজপুত্র, রাজকন্যা, রাক্ষস, পরী ইত্যাদি চরিত্রকে আমরা খুঁজে পাব পৃথিবীর প্রায় সব ভাষার শিশু-সাহিত্যে। উপন্যাসে খুঁজে পাওয়া যাবে নায়ক, নায়িকা, ভিলেন, প্রেম, বিরহ, সংঘাত ও শান্তিকে। প্রাচীন যুগে যখন পৃথিবীর এক প্রান্তের সাথে অন্য প্রান্তের কোন যোগাযোগই ছিল না, তখনো প্রায় একই রকম কাঠামোর সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন দেশে। আমরা তাই রাম-রাবণের ‘রামায়ণ’ আর কুরু-পাণ্ডবের ‘মহাভারত’-এর সাথে ‘ইলিয়াড’ ও ‘অডেসি’র কাঠামোগত মিল খুঁজে পাই।
রাশিয়ার সাহিত্যতত্ত্ববিদ ভ্লাদিমির প্রপ রাশিয়ার বিভিন্ন রূপকথার চরিত্র বিশ্লেষণ করে ৩১টি উপাদান খুঁজে পেয়েছেন, যা আমাদের দেশের রূপকথার বেলায়ও প্রযোজ্য। বিশ্বের উপন্যাসগুলো বিশ্লেষণ করলেও এক ধরনের কাঠামোগত মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
কাঠামোবাদ দিয়ে সাহিত্যকে বিশ্লেষণ করলে আমরা বিভিন্ন যুগ-বৈপরীত্যকে শনাক্ত করতে পারব। ক্লদ লোভি স্ট্রাউস, গ্রেইমাস, জোভেতান তোদোরভ, জেরার্ড জেনে, জোনাথন কালার প্রমুখের সাহিত্য বিশ্লেষণে সংস্কৃতি/প্রকৃতি, উদ্দেশ্য/বিধেয়, প্রেরক/প্রাপক, থিসিস/এন্টিথিসিস, বর্ণনা/উপস্থাপনা, ভালবাসা/ঘৃণা, ভারসাম্য/ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদির মত যুগ্ম-বৈপরীত্যের উল্লেখ আছে, যা ভাষা-কাঠামো কাঠামোবাদী সাহিত্যতত্ত্বের বিষয়।
রুশ-আকরণবাদী সাহিত্যতত্ত্ব :
রুশ আকরণবাদী সাহিত্যতত্ত্বের উদ্ভব ঘটেছিল ১৯২০/১৯৩০-এর দশকে তৎকালীন রাশিয়া এবং চেকোস্লাভোকিয়াতে। এ আন্দোলনের মূল প্রবক্তারা ছিলেন রোমান ইয়াকবসন, মিখাইল বাখতিন, জান মুকরারোভস্কি, রেনে ভেল্লেক প্রমুখ। রুশ আকরণবাদে বলা হয়, আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য যে সামাজিক ভাষা আছে, তাকে সাধারণ ভাষা হিসেবেই গণ্য করা উচিৎ। সামাজিক ভাষার কাজ হল একটি মানুষের সাথে অন্য একটি মানুষের যোগাযোগ রক্ষা করা এবং এই ভাষার প্রয়োগ/আচরণ খুবই সহজ ও সরল। সাহিত্যের ভাষা কোন অবস্থাতেই ‘সাধারণ ভাষা’ নয়, কারণ আমাদের সামাজিক ভাষাকে ‘অপরিচিতিকরণ’ করার মাধ্যমে ‘সাহিত্য-ভাষা’র সৃষ্টি হয়।
সাহিত্যের ভাষা যে আমাদের সামাজিক ভাষাকে অপরিচিতিকরণ করে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই এবং এ কারণে রুশ-আকরণবাদকে সাহিত্য-বিশ্লেষণে আনা যায়। কবি আল মাহমুদ কেন বলেন, ‘গাঙের ঢেউয়ের মত বলো কন্যা কবুল কবুল’, কেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার উপন্যাস লালসালুতে লেখেন, ‘দূরে তাকিয়ে যাদের চোখে আশা জ্বলে তাদের আর তর সয় না, দিনমানক্ষণের সবুর ফাঁসির সমান। তাই তারা ছোটে ছোটে।’ তাদের এই কথাগুলো তো সাধারণ সামাজিক ভাষার মত মনে হয় না, তারা নিশ্চয়ই অপরিচিতকরন করেছেন আমাদের দৈনন্দিন প্রকাশকে, আর তাই রুশ আকরণবাদকে সাহিত্য-বিশ্লেষণে আনা যায়।
পর্ব্ব— ৩
মনোবিশ্লেষণী সমালোচনা তত্ত্ব :
মানুষের ‘মন’ নামক ধরা-ছোঁয়ার বাইরে এক অস্তিত্ব আছে, আর মনের চেতন ও অচেতন ঘরে বন্দী হয়ে আছে মানুষের সত্তা, অস্তিত্ব, স্বজ্ঞা, সংবেদ ইত্যাদি ভাষার এক গোলকধাঁধাসহ। ফ্রয়েড, পাভলভ, ইয়ুং, লাকাঁ প্রমুখ মনস্তাত্ত্বিক/ভাষাবিজ্ঞানী মনের কপাট খুলে আমাদের দেখিয়েছেন, ভাষা দিয়ে সৃষ্ট মানুষের মন তার যে কোন কার্য্য এবং কার্য্যের কারণকে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে ‘অহং এবং ‘অতি-অহং’-কে অস্বীকার করে মানুষের অদ অনেক সামাজিক আদিম প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারে। এই আদিম প্রবৃত্তি (কামনা, বাসনা, যৌনতা ইত্যাদি) যখন কোন আর্থসামাজিক কারণে ‘অবদমিত’ হতে বাধ্য হয়, তখন তা ভাষারূপেই অবস্থান নেয় মনের ‘অচেতন’ কোটরে। ভাষা-সৃষ্ট এই অবদমিত অচেতন একজন মানুষকে বানাতে পারে মনোরোগী, কিংবা এই অবদমিত অচেতনের ভাষা বিভিন্ন রূপক ও প্রতীক সৃষ্টির মাধ্যমে একজন মানুষকে করে তোলে স্রষ্টা। একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে আমরা বলি কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার কিংবা শিল্পী। সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে যে অবদমিত কামনা-বাসনার যন্ত্রণা অবস্থান করে, এ সত্যকেও এখন আর আমরা অস্বীকার করা যায় না।
মনোবিশ্লেষণী সমালোচনা-পদ্ধতি সিগমুন্ড ফ্রয়েড আর জাক লাকাঁর তত্ত্বসমূহের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়েছে এবং এই সমালোচনাতত্ত্ব এখন বহুল ব্যবহৃত। লেখকের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণসহ একটি টেক্সট বা পাঠের অন্তর্গত মনস্তাত্ত্বিক উপাদানও এই সমালোচনা-পদ্ধতি দিয়ে উদ্ধার করা যায়। শুধু তাই নয়, একটি পাঠ কীভাবে একজন পাঠকের মনস্তত্ত্বকে প্রভাবিত করতে পারে, তাও বিবেচনা করে মনোবিশ্লেষণী সমালোচনা-পদ্ধতি। মনোবিশ্লেষণী পদ্ধতির আর একটি সুবিধা হল এই সমালোচনায় একজন সমালোচক ইচ্ছে করলে অন্যান্য সাহিত্যতত্ত্বকে টেনে আনতে পারেন এবং অন্যান্য তত্ত্বের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণও করা যায়।
অস্তিত্ববাদ/চেতনচিত্রবাদ :
জন্মের পরই মানুষ তার অস্তিত্ব নিয়ে সচেতন হয়ে যায়, তার ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কামনা, বাসনা ইত্যাদি নিয়ে সে অবস্থান করে এক স্বার্থপর সত্তা হিসেবে। ‘স্বাধীনতা’, ‘সার্ব্বভৌমত্ব’, ‘মানবিকতা’ এবং এসবের মত অন্যান্য মানবিক সত্যকে একজন মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে গ্রহণ করে সত্য, কিন্তু তারপরেও তার মনে কী যেন নেই, আরো বেশী হলে ভাল হত, পৃথিবী এক শূন্যতা ছাড়া কিছু নয়’, ‘জীবনের অর্থ নেই’, এমন সব চিন্তা ভাবনা আসে। এমন চিন্তা-ভাবনাকে ‘মনস্তাত্ত্বিক ফেনমেনা বা চেতনচিত্র’ বলতে পারি আমরা। জা-পল সার্ত্রে এবং আলবার্ট ক্যামুকে অস্তিত্ববাদী সাহিত্যতত্ত্বের মূল প্রবক্তা বলা যায় এবং তারা মনে করতেন যে, মানুষ এই অপরিচিত পৃথিবীতে অবস্থান করছে এক নির্ব্বাসিত বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসেবে, আর এই পৃথিবীতে প্রকৃত সত্য, মূল্যবোধ কিংবা জীবনের অর্থ বলে কিছু নেই। মানুষ শুধু এক ধরনের শূন্যতা থেকে জীবন শুরু করে ক্রমাগতভাবে শূন্যতা পার করে মৃত্যুকে তুলে নেয়। আমরা যাকে ‘অস্তিত্ব’ বলি তা আসলে এক ধরনের যন্ত্রণা, অথবা বলা যায় এই ‘অস্তিত্ব’ এক ধরনের অবাস্তব কল্পনা মাত্র। সার্ত্রে তার অস্তিত্ববাদী চিন্তার এক পর্য্যায়ে এসে এমনও উচ্চারণ করেন, জীবনের কোন অর্থ নেই, উদ্দশ্য নেই, শূন্যতা নিয়ে বেঁচে থাকাই জীবন।
দার্শনিক কিয়ের্কেগার্ড সার্ত্রে বা ক্যামুর মত ‘নাস্তিক’ ছিলেন না, তার অস্তিত্ববাদে অর্থহীন শূন্যতার জীবনকে ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করার কথা আছে। আমরা আমাদের জীবন ও সাহিত্যে অস্তিত্ববাদী এই শূন্যতা আর অর্থহীনতাকে খুঁজে পাব। সাহিত্যের সমালোচনায় তাই অস্তিত্ববাদকে বেশ ভালভাবেই উপস্থাপন করা যায়।
চেতনচিত্রবাদের প্রবক্তা ছিলেন দার্শনিক এডমুন্ড হুসার্ল। তাঁর মতে, যেসব বিষয় বা ঘটনা অবশ্যম্ভাবী নয় সেগুলোকে আমাদের চৈতন্য থেকে বাদ দিতে হবে এবং যা বাস্তব, যা আবশ্যিকভাবে ঘটছে, তা চেতনচিত্র হিসেবেই উপস্থিত। ‘সুর্য্য পূর্ব্ব দিকে ওঠে পশ্চিমে ডোবে’, এই সত্য যেমন একট ফেনমেনা, ঠিক তেমনভাবেই মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া সত্যগুলো অবশ্যম্ভাবী সত্য হয়েই উপস্থিত। সাহিত্যের উপস্থিত বিভিন্ন বিষয়, ঘটনা, চরিত্র ইত্যাদিকে আমরা তাই চেতনচিত্রবাদ দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারি।
পর্ব্ব— ৪
মার্ক্সবাদী সাহিত্যতত্ত্ব :
মার্ক্সবাদী সাহিত্যতত্ত্বের প্রেক্ষাপটে রয়েছে কার্ল মার্ক্স-এর সমাজদর্শন। বুর্জোয়া/প্রলেতারিয়েত, শোষক-শোষিত, সাম্রাজ্যবাদ/সাম্যবাদ ইত্যাদির মত যুগ্ম- বৈপরীত্যকে নিয়ে কার্ল মার্ক্স-সৃষ্ট দর্শন সাহিত্যে বিশেষ প্রভাব ফেলে। কার্ল মার্ক্স কথিত তত্ত্ব-ধারণা মানুষকে এক নতুন সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছিল এবং এই সাম্যবাদী সমাজের বাস্তবায়নে সারা পৃথিবীতেই খণ্ডিত/অখণ্ডিতভাবে শুরু হয়েছিল সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন/বিপ্লব। কার্ল মার্ক্স-এর দর্শনের ওপর ভিত্তি করে ভাষা ও সাহিত্যে এসেছিল নতুন চেতনাকাঠামোগত উপাদান, যা এখনো বিক্ষিপ্তভাবে ক্রিয়াশীল। মার্ক্সবাদের ওপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছিল সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্য-সমালোচনার ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল এবং আমাদের দেশেও মার্ক্সবাদী সাহিত্যতত্ত্বকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছিল প্রচুর সাহিত্যের। সাহিত্য-সমালোচনায় মার্ক্সবাদী তত্ত্বসমূহকে আমরা তাই অস্বীকার করতে পারব না।
মার্ক্সবাদ মূলত অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং শোষক/শোষিতের সম্পর্ক নিয়েই তাত্ত্বিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু এই মতবাদে অবহেলিত হয়েছিল মানুষের প্রেম, লোভ, লালসা, কাম, ধর্ম্ম এবং অন্যান্য মৌলিক মানবিক উপাদান। এক সময় মানবিক মনস্তত্ত্ব আর মার্ক্সবাদ-এর মাঝে ক্রমাগতভাবে সংঘাত বাড়তে থাকে এবং মার্ক্সবাদের পতনও অনিবার্য্য হয়ে ওঠে। মার্ক্সবাদের পতন, বুর্জোয়াতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মানুষের কাম, লোভ-লালসার জয় ইত্যাদি নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে প্রচুর এবং সাহিত্যের বিশ্লেষণে আমরা এই প্রসঙ্গগুলোও আনতে পারি বাস্তবতাকে গ্রাহ্য করে।
উত্তর-কাঠামোবাদ/বিনির্ম্মাণ তত্ত্ব :
কাঠামোবাদ ভাষা ও সাহিত্যকে একটি স্থির ও বদ্ধ কাঠামোর অন্তর্গত বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেছিল। ভাষাতে উপস্থিত প্রকৃতি/সংস্কৃতি, ভাল/মন্দ, ঈশ্বর/মানুষ, দিন/রাত্রি, পুরুষ/নারী ইত্যাদির মত যুগ্ম-বৈপরীত্যগুলোর শ্রেণী-মর্য্যাদাও ছিল স্থির। মানুষ ভাবত ‘ভাল’র অবস্থান ‘মন্দে’র ওপরে, ‘মানুষের’ অবস্থান ‘ঈশ্বরের’ নীচে ইত্যাদি ইত্যাদি। উত্তর-কাঠামোবাদ/বিনির্ম্মাণের দর্শন ব্যাখ্যা করে দেখা গেল, ভাষার শব্দসমূহের মুক্তক্রীড়ার ফলে ভাষায় কোন স্থির কাঠামো কিংবা ভাষা-অর্থের কোন নির্দ্দিষ্ট উপস্থিতি থাকে না। ভাষার উপাদান যুগ্ম-বৈপরীত্যেও ঘটে উগ্র শ্রেণী-বিচ্যুতি। যার ফলে ‘মন্দ’ উঠে আসে ‘ভাল’র ওপর, ‘মানুষ’ হয়ে যায় ‘ঈশ্বর’ থেকে মহান।
উত্তর কাঠামোবাদ বা বিনির্ম্মাণ কী, তা বোঝানোর জন্য জাক দেরিদার ভাষা-দর্শন বুঝতে হবে। দেরিদা ভাষা থেকে অধিবিদ্যা বাদ দিতে চান, আর বলেন শব্দের অর্থকেন্দ্রিক সাহিত্যে বিনির্ম্মাণ কাজ করবেই। তিনি এমনও বলেছেন যে সাহিত্য থেকে আদিবিদ্যাকে পুরোপুরিভাবে বাদ দেয়া যাবে না। বিনির্ম্মাণকে গ্রাহ্য করে একটি সাহিত্য-সৃষ্টির প্রেক্ষাপট বিচার করতে পারি আমরা, আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি একটি সাহিত্যকর্ম্মের মাঝে উপস্থিত বিনির্ম্মাণযোগ্য বর্ণনা/বক্তব্য/বিবরণ ও অন্য উপাদানসমূহকে। একটি সাহিত্যকর্ম্মে কাঠামোবাদগ্রাহ্য যুগ্ম-বৈপরীত্যের উগ্র-বিচ্যুতি কীভাবে ঘটে তা-ও বিচার-বিশ্লেষণ করা যায় এই তত্ত্ব দিয়ে। দেরিদার দর্শনের মূল কথা হল, All reading is misreading, all interpretatio is misinterpretation আর there is nothing outside text. কথাগুলো বিশ্লেশণ করলে আমরা বুঝতে পারি যে একটি লেখা পড়ার সময় আমরা তার অর্থ বিভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যাই ব্যক্তিগত ভাষাজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে, আর তাই শুধুমাত্র পাঠ বা text-এর উপাদানসমূহ বিশ্লেষণ করাই হবে যুক্তিসংগত। আমাদের বুঝতে হবে ভাষার মুক্ত-ক্রীড়া বা freeplay আমাদের সামনে উপস্থিত করতে পারে নতুন নতুন সৃষ্টির ব্যঞ্জনা আর নান্দনিক উপলব্ধি।
পর্ব্ব— ৫
আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক সাহিত্যতত্ত্ব :
আধুনিকতা আর উত্তর-আধুনিকতা নিয়ে আমাদের কিছু দ্বিধা আছে। কোথায় যে আধুনিকের শেষ, আর কখন যে উত্তর-আধুনিকতা শুরু হল এ নিয়ে আমরা তর্ক করতে পারি। কিন্তু সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। এ যেন অনেকটা আলো আর অন্ধকারের মত। কোথায় অন্ধকারের শেষ আর কোথায় আলোর শুরু, এ নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হয়। তবে এ কথা হয়ত বলা যায় যে, উত্তর-আধুনিকতা একটা ধারণা, যা আধুনিকতার মাঝে থেকেই চৈতন্যগত কারণে এক পৃথক তত্ত্ব হিসেবে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটিকে বোঝানোর জন্য একটা খুব সরল-সহজ উদাহরণ দেয়া যাক। ধরা যাক, একটি আধুনিক মেয়ে তার সময়কে গ্রাহ্য করে খুবই ফ্যাশন-সচেতন এবং সে প্রায়ই নতুন নতুন জিনস্-এর প্যান্ট আর টি-শার্ট কেনে আরো আধুনিক হওয়ার জন্য। এক সময় তার মনে হল, তার এই আধুনিকত্বে আর কোন নতুনত্ব নেই, তাকে আরো ফ্যাশন-সচেতন হতে হবে আরো আধুনিক হওয়ার জন্য। এমন একটা চেতনা-কাঠামো তৈরী হওয়ার পর সে নতুন নতুন জিনস্-এর নতুন প্যান্ট আর টি-শার্টগুলোকে ছিঁড়ে ফেলল বিভিন্ন জায়গায়, শার্ট আর প্যান্টের রঙকেও বিবর্ণ করে ফেলল ইচ্ছে মত। তার কেনা নতুন জিনস-এর প্যান্ট-শার্টের চেহারা দাঁড়াল পুরাতন ছেঁড়া-ফাড়া বিবর্ণ কাপড়ের মত এবং সে ওই কাপড় পরে নিজেকে ভাবল ‘উত্তর-আধুনিক।’ উত্তর-আধুনিক নিয়ে উপস্থাপিত উদাহরণটা হয়ত বা খুবই সহজ-সরল হয়ে গেল, কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রেও দেখা যায় এমন ঘটনা। আধুনিকতা আমাদের সমাজকে সবকিছু দেয়ার পরই, ‘আরো চাই’ ‘আরো চাই’ জনিত শূন্যতা আমাদের উত্তর-আধুনিকতার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ‘আধুনিকতা’ আর ‘উত্তর-আধুনিকতার’ মাঝে কী আছে তা নিজের ছকে দেখানো হল :
আধুনিকতা :
- আধুনিকতার সব কার্য্যের প্রেক্ষাপটে কোন কারণ থাকে, দর্শন ও তত্ত্ব থাকে।
- আধুনিকতায় পরিকল্পনার ভূমিকা থাকে, মানুষ কোন কিছু করার আগে কোন এক নির্দ্দিষ্ট পরিকল্পনা/নকশা নিয়ে এগিয়ে যায়।
- আধুনিকতায় ভালকে মন্দের ওপর রেখে একে ধরনের আলাদা মর্য্যাদা দেখা হয়।
- আধুনিকতা সমগ্র নিয়ে চিন্তা করে, কাঠামো নিয়ে চিন্তা করে।
- আধুনিকতা কোন বিষয়ের গহিনে গভীরে যেতে চায়, চায় অস্তিত্বের প্রতিষ্ঠা
- আধুনিকতা চায় একীভূত করার কোন এক প্রক্রিয়া (synthesis) এবং সমাজকে একটা কাঠামোতে বন্দী রাখতে।
- আধুনিকতা নিয়ম ও আইনকে মেনে চলে। তারা সমাজে উপস্থিত সাহিত্যিক, দার্শনিক, জ্ঞানী, পণ্ডিত প্রমুখকে মূল্যায়িত করে।
উত্তর-আধুনিকতা :
- উত্তর-আধুনিকতা যে-কোন কার্য্যকে ‘খেলা’ হিসেবেই গণ্য করে, কোন কারণ, তত্ত্ব বা দর্শন নিয়ে চিন্তা করে না।
- উত্তর-আধুনিকতা পরিকল্পনাহীন। ‘হঠাৎ করে’ যা খুশি তাই করা যায়।
- উত্তর-আধুনিকতায় ভাল-মন্দ বিচার করার সময় নেই এবং এ কারণে বিশৃঙ্খলাও আসতে পারে।
- উত্তর-আধুনিকতা বিনির্ম্মাণ করে নতুন কিছু করার চিন্তা করে।
- উত্তর-আধুনিকতা শুধুমাত্র বাহ্যিক ব্যাপারটাই বুঝতে চায়, গহিন-গভীরে দৃষ্টি দেয়ার সময় নেই। অস্তিত্বের অনুপস্থিতি উত্তর-আধুনিকতায় কাম্য।
- উত্তর-আধুনিকতা synthesis-এর বিপক্ষে, antithesis দিয়ে ভাঙতে চায় সমাজকে।
- উত্তর-আধুনিকতা নিয়ম ও আইন ভাঙতে চায়। সমাজ উপস্থিত কোন ব্যক্তিই তাদের কাছে বড় কিছু নয়।
আসলে ‘আধুনিকতার’ বিরুদ্ধে সময়কেন্দ্রিক বিদ্রোহের নামই ‘উত্তর-আধুনিকতা’। আমাদের সমাজ, সাহিত্য ও দর্শনে যেহেতু উত্তর-আধুনিকতার প্রকাশ ঘটেছে, তাই আমাদেরও উচিৎ হবে ‘উত্তর-আধুনিকতা’ তত্ত্ব দিয়ে আমাদের সাহিত্যকে বিচার করা।
পর্ব্ব— ৬
উত্তর-উপনিবেশবাদ :
মূলত ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন আর পর্তুগালের উপনিবেশ ছিল বিভিন্ন তৃতীয় বিশ্বের দেশ। উপনিবেশ থাকাকালে এই দেশগুলোর সমাজ, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, মূল্যবোধ ইত্যাদি প্রচণ্ডভাবে বিনির্ম্মিত/নবনির্ম্মিত হয়। যা উত্তর-উপনিবেশবাদের আলোচ্য বিষয়। ব্রিটেনের উপনিবেশ থাকাকালে ইংরেজ সমাজ ও ইংরেজী ভাষা, সাহিত্য ইত্যাদি বাংলাদেশের বাঙ্গালদের মধ্যে কী কী পরিবর্ত্তন এনেছে, তা আলোচনা করা যেতে পারে উত্তর-উপনিবেশবাদ বোঝার জন্য।
বাংলাদেশের বঙ্গাল সমাজ প্রথমত উত্তর-ভারত থেকে আগত আর্য্য ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবে জাত-পাত-কেন্দ্রিক বিভাজনে বিভক্ত হয়ে অবস্থান করত। পরবর্ত্তিকালে মুসলমান পাঠান ও মোগলদের উপনিবেশ হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। এ সময় বাংলা ভাষায় ফারসী, আরবী ভাষা-শব্দের সংযোজন ভাষাকে গতিময় করে তোলে, যদিও তখন পর্য্যন্ত বাংলা ভাষায় সংস্কৃতের প্রভাবই ছিল বেশী। মুসলমান শাসন আমলে বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির মত সুযোগ বেশী এসেছিল, এ সত্যও আমরা উদ্ধার করতে পারি, কিন্তু সামাজিক চরিত্রের পতনও হয়েছিল এ সময়েই উল্লেখযোগ্যভাবে। সমাজ বিভক্ত হয়েছে জাত-পাত আর ধর্ম্মকে কেন্দ্র করে, সমাজে অবস্থান করছিল শ্রেণী হিন্দু/অন্ত্যজ হিন্দু, হিন্দু/যবন, হিন্দু/ম্লেচ্ছ, হিন্দু/নেড়ে, মুসলমান/মালাউন, মুসলমান/নাছারা, মুসলমান/কাফের ইত্যাদির মত যুগ্ম-বৈপরীত্য। একটি সমাজ যেহেতু জাত-পাত ও ধর্ম্মকে কেন্দ্র করে বিভক্ত ছিল, সেহেতু স্বাধীন-সার্ব্বভৌম রাষ্ট্রের চিন্তা বঙ্গালদের মাঝে কখনো আসেনি, তারা সবসময় পরাধীন থেকে জাত-পাত নিয়েই ব্যস্ত থাকত বেশী। ইংরেজরা এসে বঙ্গাল হিন্দু-মুসলমানদের এই সংঘাতকে কাজে লাগল, Devide and rule-নীতি প্রয়োগ করে তারা শাসন করল বাংলাদেশকে প্রায় ২০০ বছর।
আমাদের দেশের লোকজন সবসময় ‘সাদা চামড়ার’ ভক্ত। আর্য্য ফর্সা ব্রাহ্মণদের বঙ্গালরা শোষণ করার অধিকার প্রায় বিনা বাধাতেই দিয়েছিল। ‘ফর্সা’ সাহেবেরাও অনেক সময় দেবতার মতই ছিল বঙ্গালদের তৎকালীন চেতনাকাঠামোতে। ফর্সা ‘সাহেব’দের মত ধনী, বড়ো চাকরিজীবী বঙ্গালরাও ‘সাহেব’ হতে চাইল; চক্রবর্ত্তী বাবু, মুখুজ্জ্যে বাবু, বাঁড়ুজ্যে বাবু, গোস্বামী বাবু, মিত্র বাবু, ইসলাম বাবু, সবাই ‘বাবু’, বাদ দিয়ে হয়ে গেলেন ‘সাহেব’। অফিসের কেরানী বাবুই রয়ে গেল। তখনকার বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, মিত্র, গোস্বামী ঠাকুর, চক্রবর্ত্তী সাহেবরা, সাহেব হতে চাইলেও ইংরেজদের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে পারলেন না। বিলেতি মদ্যপান আর বাঈজী নাচিয়ে তাই তারা সৃষ্টি করলেন ‘বাবু সংস্কৃতি’র। সমাজে পরিবর্ত্তন আসল অনেক, আদি বঙ্গাল সংস্কৃতি থেকে ক্রমাগতভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘বাবু সংস্কৃতি’র ছায়াতে তৈরি হতে থাকল এক ধরনের ‘ইঙ্গবঙ্গ’ সংস্কৃতি। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতবৃন্দ ইংরেজ পণ্ডিতদের সাহায্য নিয়ে কিছু বাংলা পুস্তক রচনা করলেন, যা আসলে ছিল দেব-ভাষা সংস্কৃতের কাছাকাছি। সংস্কৃত আর ইংরেজী ব্যাকরণ মিশিয়ে তৈরী হল বাংলা ব্যাকরণ, যা এখন পর্য্যন্ত পুরোপুরি বাংলা-ব্যাকরণ হিসেবে বিবেচ্য নয়।
ইংরেজী ভাষার প্রতিও সাধারণ মানুষ ও পণ্ডিতদের দুর্ব্বলতা বাড়তে লাগল, তারা শিখতে চাইলেন ভাষাটি (অবশ্য মোল্লাদের কথায়/ফতোয়ায় মুসলমানরা নাসারাদের ভাষা শিখতে রাজি ছিলেন না)। প্রথমদিকে ‘গরু মানে cow আর ষাঁড় মানে husband of cow’-জাতীয় ইংরেজী জ্ঞান নিয়ে বঙ্গালরাও এগুতে থাকলেও, পরবর্ত্তিকালে ইংরেজী সাহিত্য আর দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হলেন আমাদের সাহিত্যিক/দার্শনিকবৃন্দ। আমাদের দর্শন থেকে হারিয়ে গেলেন পাণিনি, পতঞ্জলি, বদরায়ন, নাগেশ ভট্ট প্রমুখ, আমরা ভুলে গেলাম আউল-বাউল-সহজিয়া মতবাদ, আর আমাদের চিন্তা-চেতনায় বাসা বাঁধল দেকার্ত, শপেনহাওয়ার, হেগেল, মার্ক্স, রাসেল প্রমুখ। বাংলা সাহিত্যেও প্রভাব ফেলল পশ্চিমের কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও দার্শনিকবৃন্দ। আমরা যদি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বিশ্লেষণ করি, তবে আমাদের কবিতা, উপন্যাস আর নাটকে পশ্চিমের স্বাক্ষর আবিষ্কার করতে পারব। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, আমরা যদি ইংরেজদের উপনিবেশ না হতাম, তাহলে আমাদের দর্শন ও সাহিত্য কেমন হত? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে যদি আমরা আমাদের সাহিত্য, সমাজ ও দর্শনকে বিশ্লেষণ করি, তবে উপনিবেশবাদ নিয়ে আমাদের কিছু চিন্তাভাবনা করতেই হবে।
প্রত্নগঠন/পুরাণকেন্দ্রিক সমালোচনা :
কার্ল ওস্তাফ ইয়ুং, জোসেফ ক্যাম্পবেল, রবার্ট গ্রেভস, ফ্রানসিস ফরগুসন, ফিলিপ হুইলরাইট, লেইসি ফিল্ডার, নরথ্রপ ফ্রাই, মাওদ বোদকিন এবং উইলসন নাইপ্রত্নগঠ প্রত্নগঠন/পুরাণকেন্দ্রিক সমালোচনার প্রবক্তা। এ তত্ত্বে মানুষের চেতন ও অচেতনের প্রত্ন ও পুরাণকেন্দ্রিক সংগঠনকে বিশ্লেষণ করা হয় যা যে-কোন সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে উপস্থিত থাকে। কার্ল ইয়ুং তাঁর মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্বে বলেছেন যে, প্রত্ন-ইতিহাসবাহিত কোন ঘটনা কিংবা আমাদের জানা কোন পুরাণকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহ আমাদের মনের গহিনে মনস্তাত্ত্বিক তলানি হিসেবে অবস্থান করে এবং সেসবের প্রকাশ ঘটে আমাদের কর্ম্ম ও সাহিত্যে।
প্রত্নগঠন/পুরাণকেন্দ্রিক সাহিত্য-সমালোচনার প্রেক্ষাপট খুঁজতে আমাদের যেতে হবে আমাদের শৈশবে, আমাদের ধর্ম্ম ও সমাজবাস্তবতা। ছেলেবেলায় আমরা গল্প শুনতাম ভূতের লালপরী-নীলপরীর, রাজকুমার, মদনকুমার আর রাজকন্যা মধুমালার, কঙ্কাবতীর। আমরা জানি, বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী, রূপবানকন্যা, গুনাই বিবি আর নসিমন বিবির গল্প, কারবালার ঘটনা, রাম-রাবণের ‘রামায়ণ’, কুরুপাণ্ডবের ‘মহাভারত’ ইত্যাদির মত বিভিন্ন প্রত্নকথা ও পুরাণকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহ। এসব রূপকথা আর পুরাণকেন্দ্রিক ঘটনা আমাদের যৌথ অচেতনে অবস্থান করে ছায়ার মত এবং অনেক সময় আমাদের কাজ ও কর্ম্মে এই প্রত্নকথা বা রূপকথার উপাদান চলে আসে। সাহিত্য-সৃষ্টির বেলায় মনস্তাত্ত্বিক কারণেই এই বিষয়গুলো আসতে পারে, আর তাই প্রত্নগঠন/পুরাণকেন্দ্রিক সমালোচনা করে আমরা সাহিত্যের সত্য উদ্ধার করতে পারি।
পর্ব্ব— ৭
দাদাবাদ/পরাবাস্তববাদ :
অর্থহীন-যুক্তিহীন শব্দও মানুষকে নান্দনিক উপলব্ধি দিতে পারে অনেক সময়, এ সত্য আমরা বুঝি যখন ‘হাট্টিমা টিম টিম, তারা মাঠে পাড়ে ডিম’-জাতীয় কিছু পড়ি। দাদাবাদের জন্মও হয়েছিল এক ধরনের অর্থহীন, যুক্তিহীন এবং স্বেচ্ছাচারী ভাষা প্রয়োগে সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াসে। ১৯২৪ সালে আদ্রেঁ ব্রেতো ‘পরাবাস্তববাদের ইশতেহার প্রকাশ করেন। পরাবাস্তববাদ কল্পনা, স্বপ্ন, দিবাস্বপ্ন এবং অযৌক্তিক উপাদানকে সাহিত্য সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করে। অনেক সামাজিক যুক্তির সাথে মেশানো হয় অযৌক্তিক পরাবাস্তববাদী উপাদান। আধুনিককালের অনেক কবির কবিতায় আমরা পরাবাস্তববাদী পাব, অনেক উপন্যাসেও পাব অযৌক্তিক স্বপ্নকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা। জাদু-বাস্তবতা দাদাবাদ/পরাবাস্তববাদের মতই একটা ব্যাপার, এটাও এখানে বলা আবশ্যক।
পাঠক-প্রতিক্রিয়া তত্ত্ব :
একটি সাহিত্যকর্ম্ম পাঠের সময় পাঠকের ‘যোগ্যতা ও কৃতী’ প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে এবং পাঠকের যোগ্যতা, শিক্ষা, জ্ঞান ইত্যাদির মত উপাদানের ওপর নির্ভর করে সাহিত্যকর্ম্মটি বিশ্লেষিত হয়। ওলফ্গ্যাং আইসার-এর মতে, সাহিত্যের পাঠ হল পাঠক ও পাঠের মাঝে অবস্থানকারী এক ধরনের দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া, যা পাঠের সময় পাঠ ও পাঠকের মাঝে সমানভাবে কাজ করে। পাঠক-প্রতিক্রিয়া তত্ত্ব সাহিত্য সমালোচনায় প্রত্যক্ষভাবে আনা যায় এবং এ ব্যাপারে আরো জানার জন্য আই. এ. রিচার্ডস, লুইস রোজেনব্লাট, স্ট্যানলি ফিস প্রমুখ সাহিত্যতাত্ত্বিকের লেখা পড়া যেতে পারে।
নারিবাদী সাহিত্যতত্ত্ব :
সেই আদি-গুহামানবের যুগ থেকেই নারীর শ্রেণিমর্য্যাদার উগ্র বিচ্যুতি ঘটে, পুরুষের স্থান হয় নারীর ওপরে, তৈরী হয় ‘পুরুষ/নারী’ যুগ্ম-বৈপরীত্যটির। এই যুগ্ম-বৈপরীত্য গ্রাহ্য করে ভাষায় ক্রমাগতভাবে আরো অনেক কাঠামোগত যুগ্ম-বৈপরীত্য স্থান করে নেয় এবং প্রতিটি যুগ্ম-বৈপরীত্যে নারী হয় অবহেলিত। সূর্য্য পুরুষ হলে নারী চাঁদ; আলো যদি হয় পুরুষ, তবে নারী অন্ধকার; পুরুষের স্থান যদি হয় ওপরে, নারী থাকবে নিচে; বাহির যদি হয় পুরুষের তবে ঘর হবে নারীর, এমন সব ভাষাকেন্দ্রিক যুগ্ম-বৈপরীত্য নারীকে অবহেলা করছে বারবার। আমরা যে আদি-সাম্যবাদী সমাজের চিন্তা করি, যেখানে ছিল সম্পদের সুষম বণ্টন, সেখানেও ‘নারী’ হয়ে গিয়েছিল ‘প্রথম সম্পদ’; কারণ যে পুরুষের শক্তি ছিল বেশী, তার নারীকে স্পর্শ করার ক্ষমতা অন্য কারো ছিল না। আসলে নারী সম্পদ হয়েছিল মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি যৌনতাকে কেন্দ্র করে। যৌন-ক্রিয়ার সময় নারীর অবস্থান, পুরুষাঙ্গ দিয়ে নারীকে বিদ্ধ করার ক্ষমতা ইত্যাদি ছিল প্রাথমিকভাবে নারীর শ্রেণিমর্য্যাদা পতনের প্রধান কারণ। ভাষার বিবর্ত্তনের সাথে সাথে, সেই আদিম যুগ্ম-বৈপরীত্যগুলোর প্রসার ঘটে এবং নারী আর কখনো তার সামাজিক মর্য্যাদা উদ্ধার করতে পারেনি। কখনো কখনো নারী দেবী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বটে, কিন্তু তা হয়েছে আদিম যাদু-বাস্তবতার ফলে। আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা যখন একটি নারীর গর্ভ থেকে অন্য এক নারী বা পুরুষের জন্মগ্রহণের বিচিত্র চিত্র দেখত, তখন তা তাদের জন্য এক ধরনের জাদুবিদ্যাজাত উপলব্ধি নিয়ে আসত এবং পরবর্ত্তিকালে নারীকে তারা গ্রহণ করত একজন জীবনরক্ষাকারী সত্তা হিসেবে, মা হিসেবে। কখনো যৌন উত্তেজনায় তারা নারীকে আনত স্বপ্নের চরিত্র হিসেবে, দেবী হিসেবে। আমরা দেবী হিসেবে ভেনাস, আফ্রোদিতি, দুর্গা, কালী এবং অন্য যে সত্তাগুলোকে চিহ্নিত করেছি, তা আসলে এক ধরনের কামনা/বাসনা কিংবা জাদুবিদ্যাজাত উপলব্ধির ফসল।
বিশ শতকে এসে নারিবাদী দর্শন ও তত্ত্বের প্রসার ঘটে। সিমন দ্যা বোভেয়া, বেটি ফ্রাইডেন, কেট মিলেট, জুডিথ ফেটারলি, এলিন শোওয়াল্টার, সান্ড্রা গিলার্ট সুসানগুবার, জুলিয়া ক্রিস্টিভা, টরিল মোই, কেলি অলিভার প্রমুখ হলেন আধুনিক নারিবাদের প্রবক্তা। মূলত পুরুষের সমান অধিকার চেয়ে নারিবাদী দর্শন তত্ত্বের প্রসার ঘটলেও, পরবর্ত্তী পর্য্যায়ে নারিবাদী সাহিত্য বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়। ফরাসী নারী-বাদে, নারীর অবমূল্যায়নের প্রেক্ষাপটে অবস্থানরত মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলোর ওপর জোর দেয়া হয়। কিন্তু তত্ত্বে ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্লেষণ করা হয় এবং সিদ্ধান্ত আসে যে, ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শন আসলে প্রকাশের সময়ই পুরুষতন্ত্রের পক্ষে উপস্থাপিত হয়েছিল। নারিবাদের একাট শাখা নারীদের অধিকার আদায়ের তত্ত্ব উপস্থাপন করার সাথে সাথে জরায়ুর স্বাধীনতা, অবাধ যৌন-সম্ভোগের অধিকার এবং নারী-সমকামিতার পক্ষেও বক্তব্য রেখেছে। বাংলা সাহিত্যেও নারিবাদকেন্দ্রিক চিন্তা-চেতনা এসেছে বিশ শতকের প্রথম থেকেই। প্রথম দিকে নারী-স্বাধীনতার বক্তব্য/বিবরণ সীমাবদ্ধ ছিল ঘর ও পরিবারকে কেন্দ্র করে, কিন্তু পরবর্ত্তী পর্য্যায়ে নারিবাদী চিন্তা-চেতনার ঘর ও পারিবারিক গণ্ডি পেরিয়ে সামাজিক আন্দোলন হিসেবেই উপস্থাপিত হয়। নারিবাদী সাহিত্যতত্ত্ব দিয়ে অমরা তাই এসব সাহিত্যকর্ম্মের মূল্যায়ন অবশ্যই করতে পারি।
মঈন চৌধুরী রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত প্রবন্ধ, ভাষা ও সাহিত্য সমালোচনা তত্ত্ব — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।