জীবন নিয়ে অনেক তত্ত্বকথা আছে। এইসব তত্ত্বকথায় আছে ধর্ম্মতাত্ত্বিক মতামত, পুরাণকেন্দ্রিক গল্পকাহিনী, অধিবিদ্যাজাত উপস্থাপনা, বস্তুবাদী মতামত আর বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ৷ আমি জীবন নিয়ে বলতে গিয়ে তত্ত্বকথা শুনাব না, বরং আমার সামান্য জ্ঞানকে অবলম্বন করে প্রায় মুর্খের মত অতি সহজ ভাষায় কিছু বলবো৷ আমার কথায় অধিবিদ্যাজাত দর্শন, বস্তুবাদ ভিত্তিক কথা আর বিজ্ঞান চিন্তা থাকবে, কিন্তু পুরানকেন্দ্রিক ভাবনা আর ধর্ম্মতাত্ত্বিক চিন্তাচেতনাকে বাদ দেবো৷ তবে আমি মানুষের বিশ্বাসের মূল্য দেই, তাই ধর্ম্মতত্ত্ব আর পুরাণকেন্দ্রিক চিন্তা চেতনার সামালোচক হলেও আমি বিরোধী নই৷ যাহোক, এবার তবে জীবন ও মানুষ নিয়ে কথা বলি, যার ভিত্তি হবে বিজ্ঞান দর্শন৷
আমাদের এই মহাবিশ্ব হল বস্তু, বস্তুধর্ম্ম, সময়, স্থান, ঘটনা আর শক্তির এক বিচিত্র সংগঠন৷ এই মহাবিশ্বের কোন এক অজানা কেন্দ্রে কোন এক এককত্ব বা সিংগুলারিটির অনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণে আমাদের মহাজগৎ আর সৌরজগৎ সৃষ্টি হয়েছিল৷ সৃষ্টির পর এই মহাজগৎ আর সৌরজগৎ বস্তু, বস্তুধর্ম্ম, সময় আর শক্তি নিয়ে, গনিতকে গ্রাহ্য করে, এসে পৌঁছেছে এই বর্ত্তমানে৷ সৃষ্টির এই ঘটনার কিছু আমাদের জানা, তবে অনেকটাই অজানা, আর তাই জন্ম হয়েছে অধিবিদ্যার৷
এবার জীবনের কথা বলি৷ জীবনবস্তু হল একটী এককোষী বা বহুকোষী প্রাণী। দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু একটী অক্সিজেন পরমাণুর সাথে বিক্রিয়া করে যেমন একটী পানীর অণু (H2O) তৈরী করে, ঠিক তেমন ভাবে কার্বন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন, ক্যালসিয়াম, সালফার, ম্যাঙ্গানিজ ও অন্যান্য পরমাণু কোন একটী নিদৃষ্ট কোয়ান্টাম তেজে, মাত্রায় ও গঠনে সৃষ্টি করেছিল ‘জীবনবস্তু’।
জিবনবস্তু মানুষ এসেছে বহুকোষী প্রানী থেকে৷ ডারউনের প্রমানিত বিবর্ত্তন তত্ত্ব মেনে, বানর সাদৃশ্য ‘হোমিনিড’ প্রজাতী পেরিয়ে বর্ত্তমানে এসে পৌঁছেছে মানুষ৷ মানুষ, মানুষ হবার আগের পর্য্যায়গুলো ছিল:
- — ড্রাইয়োপিথেকাস (Dryopithecus)
- — রামাপিথিকাস (Ramapithecus)
- — অস্ট্রালোপিথিকাস (Australopithecus)
- — হোমো ইরেকটাস (Homo Erectus)
- — নিয়েন্ডারথালিস (Neanderthalensis)
- — হোমো সেপিয়েন্স (Homo Sapiens)
হোমোসেপিয়েন্স থেকে কিছুটা সভ্য হয়ে আমরা হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স হয়েছি আর আমাদের ওপর আরোপ করেছি ‘মানবত্ব’ নামের এক বিশেষণ৷ ইন্দ্রিয়নির্ভর কিছু স্বভাবের কারণে আমরা এখনো আমাদের জীনের কোয়ান্টাম নক্সায় বহন করছি প্রাণী বা পশুর চরিত্র৷ মানুষ হয়ে আমরা আমাদের বাঁচার ইচ্ছে, ক্ষুধা, কাম, প্রজনন-বাসনা, লোভ, ক্ষমতা, দখল করার ইচ্ছে, যুদ্ধ ইত্যদির মত গুণ নিয়ে অস্বীকার করছি মানবত্ব নামের বিশেষণকে৷ তবে আমাদের মাঝে কিছু কিছু মানুষ মানবিকতা মেনে আর বুঝে মানব হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই৷
সবশেষে বলব, আমরা যেহেতু মানবত্ব আরোপিত হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স হয়েছি, পরিচিত হয়েছি মানবিক গুণের অধিকারী মানব হিসেবে, তাই আমাদের উচিৎ হবে আমাদের জীনের কোয়ান্টাম নক্সা থেকে পশু সমাজের দোষগুলো বাদ দেয়া৷
মানুষ ও মানবত্ব—
এক কোষের এক জীবনবস্তু বা অণুজীব থেকে শত কোটি বছরের বিবর্ত্তনে আমরা মানুষ হয়েছি৷ মানব সভ্যতার কোন এক বিন্দুতে এসে আমাদের ওপর চাপানো হয়েছে ‘মানবত্ব’ নামের এক বিশেষণ৷ মানবিক গুণের কিছু তত্ত্বও আমরা পেয়েছি৷
আমাদের মাঝে কিছু মানুষ মানবত্ত্বের এইসব তত্ত্বকথা মনস্তাত্ত্বিক ভাবে মেনে ‘মানব’ হয়েছি, আর বেশীরভাগ মানুষ পশু বা প্রাণীই রয়ে গেছি৷ মানুষের এই পশুসত্তার জন্যই পৃথিবীতে আজও আছে যুদ্ধ, খুন, গুম, ধর্ষণ, শোষণ, অন্যায়, অবিচার, ক্ষমতার বাড়াবাড়ি এবং অমানবিক সব কর্ম্মকান্ড৷
সত্য কথা খুব ভাল শোনায় না, তবু সত্যই বললাম৷
নারী—
হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স নামের মানুষ প্রজন্ম হেমিনিড গোত্রের হোমো ইরেকটাস, হোমো এরগাসটার, হোমো নিয়েনডারথালেনসিস, ইত্যাদি পর্য্যায় পেরিয়ে বিবর্ত্তনের মাধ্যমে বর্ত্তমানে এসে পৌঁছেছে। আমাদের প্রাগৈতিহাসিক আদি-পূর্ব্বপুরুষেরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত হয়ে গুহাতে থাকত এবং শিকার করে জীবনযাপন করত। তাদের চিন্তা-চেতনায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক সম্পদের ধারণা খুব একটা ছিল না এবং এর ফলে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস্ আর ভিআই লেনিন-এর দর্শনে আমাদের এই পূর্ব্বপুরুষদের সমাজকেই আদি-সাম্যবাদী সমাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
বাস্তবে এই সাম্যবাদী সমাজেও সম্পদের ধারণা এসে গিয়েছিল যৌনতা ও প্রজন্ম সংরক্ষণের জৈবিক ইচ্ছাকে কেন্দ্র করে আর ‘নারী’ হয়েছিল মানুষ-সমাজের প্রথম সম্পদ। গুহাকেন্দ্রিক সাম্যবাদী সমাজে একজন ভাল শিকারী, যার শক্তি ছিল তুলনামূলকভাবে বেশী, সেই পুরুষটী লোভ, লালসা, কামনা, ঈর্ষা ইত্যাদির মত মানবিক গুণাবলী বা স্বভাবের প্রকাশ ঘটিয়ে, গুহায় অবস্থানকারী নারীদের মাঝ থেকে কিছু পছন্দের নারীকে তার নিজস্ব সম্পদ হিসেবে ঘোষণা দিত। একজন শক্তিশালী পুরুষের সম্পদ সবসময় যে তার নিজস্ব সম্পদ হিসেবে অবস্থান করত, তা কিন্তু নয়। গুহার সমাজে নতুন প্রজন্মের কোনো পুরুষ নতুন শক্তি নিয়ে, নতুন শিকারের পদ্ধতি আবিষ্কার করে, নতুনভাবে অধিকার করে নিত নারীদের। নারীর অধিকার নিয়ে গুহামানব সমাজে তাই মাঝে মধ্যে ঝগড়া-বিবাদও লেগে থাকত।
হোমো সেপিয়েন্স মানব গোষ্ঠী বিবর্ত্তনের কোন এক সময় নারীকে ‘জৈবিক প্রজন্ম উত্তরণ সহায়ক শক্তি’ হিসেবে বানাল দেবী। আমাদের পূর্ব্বপুরুষ গুহামানবদের ভাষা ছিল প্রাথমিক পর্য্যায়ের, আর এ কারণে ‘নারী/পুরুষ’ কিংবা ‘নারী/দেবী’ ইত্যাদির মত যুগ্ম-বৈপরীত্য তখনো চেতনা-চৈতন্যের অংশ হয়ে অবস্থান করত না। তবে সে সময় নারীদের ‘দেবী-রূপ’-এর প্রভাবে বিক্ষিপ্তভাবে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাও কায়েম হয়েছিল আমাদের গোত্রকেন্দ্রিক কোন কোন সমাজে, দেবী পূজাও হত৷
এক সময় মানুষের ভাষাও বিবর্ত্তিত হয়ে এক ধরনের কাঠামোগত নিয়মের আওতায় চলে আসে (আমি এ মুহূর্ত্তে স্মরণ করছি ক্লদ লেভিস্ট্রাউসের ভাষা দর্শন), এবং এই ভাষা-কাঠামোর উপাদান সৃষ্টি করে বিভিন্ন যুগ্ম-বৈপরীত্য। এই যুগ্ম-বৈপরীত্য সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে অবস্থান করছিল লিঙ্গকেন্দ্রিক চিন্তা-চেতনা এবং ভাষার প্রতিটি শব্দের উৎসেই ‘নারী’ ও ‘পুরুষ’ সম্পর্কীয় প্রচ্ছন্ন ধারণা জুড়ে দেয়া হয়। লিঙ্গকেন্দ্রিক চিন্তা-চেতনা যে যুগ্ম-বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছিল তাতে পুরুষের অবস্থান চলে আসে নারীর ওপরে, সূর্য্য হয়ে যায় পুরুষ, চন্দ্র হয়ে যায় স্ত্রী-লিঙ্গের, দেবীর ওপরে স্থান হয় দেবতার। দেবতা থেকেই লিঙ্গকেন্দিক চিন্তা চেতনায় নারী হয়ে যায় ভোগের বস্তু বা যোনী৷ পুরুষের এই লিঙ্গকেন্দ্রিক চিন্তা চেতনা থেকে নারী আর মুক্তি পায়নি, অধিকার বঞ্চিত হয়ে বারবার নারী হয়েছে নির্য্যাতিতা৷ উনিশ শতক থেকে নারীরা তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়, সৃষ্টি হয় নারীবাদের৷ তবে এই একবিংশ শতকে এসেও নারীরা এখনো অধিকার বঞ্চিত আর নির্য্যাতিতা হয়েই অবস্থান করছে৷
বর্ত্তমান বাংলাদেশের মুসলমান পুরুষ জনগোষ্ঠীর কোনো দেবী নেই। নারী বা মায়ের পায়ের নিচে পুরুষের বেহেস্ত, এমন একটা মিথ্যা কথা দিয়ে নারীদের মূল্যায়ন করা হয়েছে। এখন পুরুষদের জন্য আছে আরব্য-রজনীর ইতিহাস, এক-বিবি, বহু-বিবি, পতিতা আর বেশ্যা কেন্দ্রিক কামনা-বাসনা এবং সব শেষে বেহেশতের হুর ও পরীদের স্বচ্ছ নরম কোমল শরীরের স্বপ্ন। বাংলাদেশে এখন নারীরা কিছুটা অধিকার সচেতন হলেও, এগিয়ে যাওয়া অনেক বাকী৷ আমাদের দেশের প্যারাডাইম গ্রাহ্য নারিবাদ নিয়ে তাদের এগুতে হবে, সাথে থাকতে হবে পুরুষদেরও৷
চিন্তা—
ইনডাক্টিভ আর ডিডাক্টিভ লজিক এবং কিছু গাণিতিক সূত্র গ্রাহ্য করে আমাদের চিন্তা সবসময় কোন একটী চিন্তাকাঠামো বা প্যারাডাইম মেনে চলে। আমরা যদি যৌক্তিক ভাবে, গাণিতিক ভাবে প্রমাণ করতে পারি যে ‘ক’ একজন মানুষ, তবে অন্য কেউ কোন অবস্থাতেই চিন্তার স্বাধীনতা প্রয়োগ করে বলতে পারবে না যে ‘ক’ একজন গরু কিংবা ছাগল। আমাদের চিন্তার স্বাধীনতা নির্ভর করে চিন্তাকাঠামোতে অবস্থানকারী ‘ফাজি লজিক’ বা ‘আবছা যুক্তির’ এলাকাকে কেন্দ্র করে। এই ‘আবছা যুক্তির’ অবস্থানকে যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করে আমরা বড়জোর বলতে পারি, ‘ক’ একজন মূর্খ বা জ্ঞানী, ডানপন্থী বা বামপন্থী, ধনী বা গরীব কিংবা পছন্দমত অন্যকিছু। কোন ঘটনা কিংবা বিষয়কে বিশ্লেষণ করার জন্যও আমরা ‘আবছা যুক্তির’ এলাকা চষে বেড়াতে পারি, কিন্তু কোন অবস্থাতেই প্যারাডাইম বা চেতনাকাঠামো অতিক্রম করা উচিৎ হবে না।
চিন্তার শুদ্ধতা বিষয়টাও শুদ্ধ প্যারাডাইম গ্রাহ্য, কিন্তু আমাদের বর্ত্তমানের জ্ঞানতত্ত্ব একটা বিশেষ ‘আবছা এলাকা’ নিয়ে অবস্থান করে। যার ফলে শুদ্ধতা নিয়ে আমাদের দ্বিধা দ্বন্দ্বের শেষ নেই। আমরা যদি গাণিতিক আর যৌক্তিক কিছু দিয়ে ‘ফাজি লজিক’ জোন অতিক্রম করতে পারতাম, তাহলে আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান আরও সুন্দর হত।
ইন্দ্রিয় ও মানুষের ভাষা—
হোমোসেপিয়েস-সেপিয়েনস নামের মানব-প্রজন্মও বিভিন্ন দেশ-কালে বহুমাত্রিক যুক্তিকে গ্রাহ্য করে সমস্যার সমাধান করতে করতে বর্ত্তমানে এসে পৌঁছেছে। বিভিন্ন মাত্রার জাগতিক সমস্যা সমাধানের জন্য মানুষও ব্যবহার করেছে ইন্দ্রিয়নির্ভর দেহের ভাষা, চোখের ভাষা, হাতের ভাষা, মুখের ভাষা, যৌন ভাষা আর লিখিত ভাষাচিহ্নকে। ভাষা শুধুমাত্র মুখের হয় আর লিখিত হয়ে ধারণাও এখন আর সত্য বলে মেনে নেওয়া যায় না। মানুষের ইন্দ্রিয়নির্ভর যে-কোনো কর্ম্মকান্ডই যেহেতু অর্থবোধক ভাষা হিসেবে প্রকাশ পেতে পারে, সেহেতু জাগতিক যেকোন সমস্যা ও তার সমাধান মানবিক ইন্দ্রিয়কে গ্রাহ্য করেই আবর্ত্তিত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, জন্মের পর মানুষ তার ছয় ইন্দ্রিয় (চোখ, কান, নাক, মুখ, যৌনাঙ্গ ও ত্বক) দিয়েই পরিবেশ-পৃথিবীর কণাতরঙ্গচিত্রকে মস্তিষ্ক-নিউরনে সংরক্ষণ করে থাকে এবং এ ধরনের জৈবিক কর্ম্মকান্ডে ক্রোমোজমবাহিত সহজাত প্রবৃত্তির ভূমিকাও থাকে প্রত্যক্ষভাবে। আমার ধারণায়, অহংসম্পর্কীয় চিন্তাভাবনা ও যৌক্তিক বিশ্লেষণে একজন মানুষ তার যৌনাঙ্গকেও একটী পৃথক ইন্দ্রিয় হিসেবে প্রাধান্য দেয় এবং এ কারণে ভাষাকেন্দ্রিক সমস্যা ও সমাধানের মানুষের যৌনাঙ্গকে একটী পৃথক ইন্দ্রিয় হিসেবে প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ। ফ্রয়েড, ইয়ং, পাবলভ, লাকাঁ প্রমুখের তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে ইন্দ্রিয় হিসেবে যৌনাঙ্গকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব।
ভাগ্য বলি কাকে? —
আমাদের পৃথিবী আর মহাজগৎ বিভিন্ন মৌলিক আর যৌগিক বস্তু নিয়ে গঠিত এবং প্রতিটি মৌলিক আর যৌগিক বস্তুর নিজস্ব বস্তুগুণ আছে। এখন আমি যদি প্রশ্ন রাখি ‘অক্সিজেন-এর ভাগ্য কী?’, তবে আমাদের জানতে হবে মৌলিক বস্তু অক্সিজেন-এর পরিবেশ কী আছে এবং কী অবস্থায় আছে। অক্সিজেন যদি উপযুক্ত পরিবেশে হাইড্রোজেন পায়, তবে তার ভাগ্য হবে পানী, আর যদি কার্বনের পাল্লায় পড়ে তবে ভাগ্যে লিখা আছে কার্বনডাইঅক্সাইড। আমাদের সামনে যে বস্তুসমূহ অবস্থান করছে, তা হয় মৌলিক (যেমন সোনা, রূপা, সালফার, অক্সিজেন, কার্বন ইত্যাদি) অথবা যৌগিক (যেমন চাঁদ, সূর্য্য, পাহাড়, গাছ, মাছ, পশু, পাখী, গাড়ী, বাড়ী ইত্যাদি)। মৌলিক বস্তুর ভাগ্য হল অন্য এক মৌলিকের সাথে এক হয়ে যৌগ গড়া অথবা ভেঙে শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়া। আর যৌগ বস্তুর ভাগ্য হল কোন শক্তির প্রয়োগে (যেমন তাপ, বিদ্যুৎ, বৃষ্টি, ঝড়, সাইক্লোন, সুনামি, ভুমিকম্প, রোগ ইত্যাদি) ভেঙে নতুন যৌগ বা মৌলিক বস্তু হওয়া।
আমরা যারা মানুষ, তারাও আসলে মৌলিক বস্তু দ্বারা সংঘটিত জৈব-যৌগবস্তু এবং আমাদের সময়কেন্দ্রিক বস্তুধর্ম্ম আছে। একজন শিশু বয়সের আমি, যৌবনের আমি আর বৃদ্ধ বয়সের আমি একই রকম বস্তুগুণ ধারণ করে না। আবার জ্ঞান কাঠামো আর পরিবেশের জন্য আমাদের বস্তুগুণ বদলায় সময়ের সাথে। আমরা তাই বলতে পারি, মানুষ হল এমন এক প্রাণী, যার বস্তুগুণ জ্ঞান, পরিবেশ, সুযোগ আর সম্ভাবনাকে গ্রাহ্য করে বদলায়। আমরা যেহেতু আমাদের আগামী জানি না, তাই আমাদের বস্তুধর্ম্ম বদলানোকেই ভাবি ভাগ্য। মানুষের যেহেতু ইচ্ছে আছে, সুযোগ আছে, সম্ভাবনা আছে, সেহেতু সে তার কর্ম্মে আর জ্ঞানে মানবিক জ্ঞানী মানুষ হতে পারে, আবার মাস্তানি করে দুর্নীতি করে রাজনীতি করে টাকার কুমীর হতে পারে। একজন মানুষ তার কর্ম্ম আর বস্তুধর্ম্ম দিয়ে অন্য একজনকে শোষণ করে ফকীর বানাতে পারে, খুন করতে পারে, গুম করতে পারে আবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে মানুষকে এক নতুন অবস্থানে নিতে পারে। কিন্তু মানুষের সব কাজই যেহেতু সময়কেন্দ্রিক, আর মানুষ যেহেতু আগামী জানে না, সেহেতু মানুষের সময়কেন্দ্রিক অবস্থানকে ভাগ্য বলেই বিবেচনা করা হয়।
ভাগ্য সম্পর্কে আমি যা লিখলাম তা আমার নিজস্ব মতামত, পাঠকের ভিন্নমত থাকতে পারে। তবে আমি মনে করি ভাগ্য কপালে লিখা নেই, ভাগ্য মানুষের কর্ম্মফল বা সময়কেদ্রিক সামাজিক আর জৈবিক বস্তুধর্ম্ম।
মানুষের মন—
মানুষের মন প্রচণ্ডভাবে গতিশীল এবং এই ‘মন’ নামক মানবিক উপাদানটি সহজাত প্রবৃত্তির, তাড়না, বিরোধ, গূঢ়ৈষা, অবদমন ইত্যাদির মত কিছু ইচ্ছামূলক ক্রিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমরা আমাদের সমাজব্যবস্থায় অবস্থান করি বিভিন্ন বিরোধ আর বাধাকে গ্রাহ্য করে এবং এর ফলে আমরা কখনোই সম্পূর্ণ স্বাধীন নই। আমাদের চিন্তারও নেই কোন স্বতঃস্ফূর্ত্ত প্রবাহ। যে কামনা, বাসনা আর যৌন-তাড়না একটী মানুষ বিভিন্ন সামাজিক নিয়মকানুনের জন্য তৃপ্ত করতে পারে না, সেই অতৃপ্তি-জাত ইচ্ছেগুলোকেই অবদমিত হয়ে স্থান করে নেয় মানুষের মনের অচেতন স্তরে। এই অচেতন স্তরেই অবদমনকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় এক ধরনের বিপরীতমুখী বিরোধ ও বাধার, যা লজ্জা, ভয়, দুঃখ ইত্যাদিসহ বিভিন্ন মানসিক/মনস্তাত্ত্বিক বিপর্য্যয়ের সৃষ্টি করে থাকে। মানুষের যে ইচ্ছে পূর্ণ হয়নি, যার জন্য সে অতৃপ্ত, সেই অবদমিত অতৃপ্তি ও ইচ্ছাগুলোই অচেতন স্তর থেকে স্বপ্ন হয়ে বেরিয়ে আসে।
ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুযায়ী মনের চেতন ও অবচেতন স্তরের সমন্বয়ে তৈরী হয় একজন ব্যক্তিমানুষের অহং। সামাজিক অহং সবসময় বাস্তবতায় নিয়মকানুন মেনে চলে এবং অচেতনে বন্দী কামজ ইচ্ছা/বাসনাকে সমাজ-বাস্তবতায় আসতে দেয় না। ফ্রয়েডের সংশোধিত মতবাদে অহং আংশিক চেতন ও আংশিক অচেতন রূপকে গ্রাহ্য করা হয়েছে। ফ্রয়েড কথিত আংশিক চেতন অহংকে আমরা শুধু অহং হিসেবেই চিহ্নিত করব এবং অচেতন অহংকে বলব অদ। অদ সবসময় সুখসূত্র মেনে চলে; জৈবিক সুখ, কামনা, বাসনা ইত্যাদির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন চায় অদ। অদ-এর জৈবিক কামনা, বাসনা ও তাড়না যেহেতু সবসময় সমাজের নিয়মকানুন মানে না, সেহেতু অহং, অদ-এর সব ইচ্ছে পূরণ হতে দেয় না বাস্তবতার সূত্র গ্রাহ্য করে। অদ-এর যে কামনা, বাসনা বা ইচ্ছা সমাজের নৈতিক আদর্শের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়, তা অপূর্ণ থেকেই অবদমিত হয়ে অচেতন মনে জমা হতে থাকে। যে অহং বাস্তবতার সূত্র মানে, তাকে ফ্রয়েড অতি-অহং বা অধিসত্তা হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন।
ফ্রয়েড তাঁর মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বে মানুষের যৌন-আকাক্ষা, অবদমন এবং শৈশবকালীন যৌনতার বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, মানুষের আত্মরক্ষামূলক কাজ হল অহং-প্রবৃত্তি। কামপ্রবৃত্তির উপাদান হিসেবে আমরা সব ধরনের প্রেম, ভালবাসা, বন্ধুপ্রীতি, আদর, সোহাগ ইত্যাদিকে চিহ্নিত করতে পারি। কামপ্রবৃত্তির উপস্থিতি হল একজন মানুষের জৈবিক সংগঠনের মৌলিক উপাদান এবং এর ফলে একটী শিশুর জন্ম হওয়ার সাথে সাথেই আত্মকামী সত্তা হিসেবে যৌন-অনুভূতিকেন্দ্রিক কামপ্রবৃত্তির দিকে এগিয়ে যায়। একটী শিশু জন্মের পর নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে স্বাধীন সত্তা হিসেবে গ্রাহ্য করে না, এ অবস্থায় সে হয়ে ওঠে এক আত্মকামী নার্সিসাস। বয়স বাড়ার সাথে সাথে একটী কিশোর যখন তার সমবয়স্ক অন্য কোনো কিশোরের ভালবাসা কামনা করে তখন মনস্তাত্ত্বিক কারণেই এক ধরনের কামপ্রবৃত্তির সৃষ্টি হয়, যাকে আমরা বলি সমকাম (এরকম যৌনচতনা যদি প্রাপ্তবয়স্ক স্তর পর্য্যন্ত চেতনায় থাকে তবে তা সমকামী বিষয় হিসেবে গণ্য হয়)। একটী শিশুর সমলিঙ্গ প্রেম সাধারণত বয়স বাড়ার সাথে সাথে চলে যায় এবং এক সময় তা নারী-পুরুষকেন্দ্রিক যৌন কামনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। কামপ্রবৃত্তির উপাদান হিসেবে আরও কিছু বিষয় নিয়ে তাত্ত্বিক ধারণা দিয়েছেন ফ্রয়েড, যার মাঝে ইদিপাস এষণা, ইলেকট্রা এষণা, মর্ষকাম, ধর্ম্মকাম, জীবনবৃত্তি এবং মরণপ্রবৃত্তি উল্লেখযোগ্য। এখানে উল্লেখ্য যে, একজন পুরুষ কিংবা নারী তাদের জৈবিক সত্তা নিয়েই নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে, কিন্তু সমাজের ভাষা ও ভাষা-নির্ভর সমাজ-দর্শন একজন নারীর মন বা মনস্তত্ত্বকে পুরুষের সমান মর্য্যাদা দেয়নি। মনে হয়, নারীদের অবমূল্যায়ন করার প্রেক্ষাপটে আছে পুরুষের মনে অবস্থান নেয়া পেশীশক্তির গর্ব্ব, বিকৃত যৌন আকাঙ্খা আর সামাজিক অবক্ষয়৷
মনস্তত্ত্ববিদ কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং-এর তত্ত্ব অনুসারে মানুষের মন বা মনস্তত্ত্ব ব্যক্তিগত হলেও, একই সমাজ আর পরিবেশে বসবাস করার ফলে ‘সামাজিক বা যৌথ’ মনস্তত্ত্ব ধারণ করতে পারে৷ তবে এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মন বা মনস্তত্ত্ব সামাজিক নিয়ম মেনে স্বাধীন ভাবেই কাজ করে৷ সব শেষে বলব, মন নিয়ে বিস্তারিত জানতে হলে ফ্রয়েড ছাড়াও ইয়ুং, পাভলভ, লাকা প্রমুখের তত্ত্ব সমুহ পাঠ করা উচিৎ৷
মানুষের চেতনা ও চৈতন্য—
আমাদের মস্তিষ্কের নিওরোণ কোষে আমরা জমা করে রেখেছি আমাদের জীবন ও জগৎ সম্পর্কীয় সব রকম তথ্য বা জ্ঞান। এ যেন অনেকটা কম্পিউটারের হার্ডডিস্কে তথ্য সংরক্ষনের মত ঘটনা। কম্পিউটারে তথ্য জমা থাকে বাইনারি কোডে, আর আমাদের মস্তিষ্ক নিওরণে জীবন ও জগৎ বিষয়ক সব ধারণা অঙ্কিত থাকে এক ধরনের জৈবরাসায়নিক বিদ্যুৎ-চৌম্বিক ক্ষেত্র দ্বারা তৈরী প্রতীকী শৃঙ্খলার বিন্যাসে।
জীবন ও জগৎ বিষয়ক প্রতীকী চিহ্নরূপকে প্রকাশ করার জন্য একজন ‘আমি’ ব্যাবহার করছে যুক্তির ভাষা, যা আবার নিজেই ইন্দ্রিয়তরঙ্গ-নির্ভর অন্য একটী প্রতীকী শৃঙ্খলার বিষয়। প্রতীক দিয়ে প্রতীক বা আন্তঃপ্রতিকী সম্পর্ককে উপস্থাপন করতে গিয়েই সৃষ্টি হচ্ছে ‘বোঝা-না বোঝার’ অহংকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব, অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বকে কেন্দ্র করে।
আমাদের মস্তিষ্কে যেহেতু ভিভিন্ন মাত্রার বিশ্বচিত্র বিদ্যমান, সেহেতু আমাদের সবার বিশ্ব আলাদা। দার্শনিক লুদভিগ হ্বিটগেন্সটাইন তাই বলেছেন— ‘I am my word’। আমাদের নিজস্ব বিশ্বকে অল্প মাত্রায় হলেও অন্যদের বোঝার মত করতে হবে। যদি তা না পারি তবে আমাদের প্রেম, ভালবাসা, সমাজ, রাজনীতি সহ কোন কিছুই সঠিক ভাবে চলবে না। আমাদের দেশে এখন এমন ঘটনাই চলছে। প্রগতিশীল, ছায়া-প্রগতিষীল, প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদী, জেহাদী, সাম্প্রদায়িক, পরশ্রীকাতর, স্বার্থপর আর মূর্খ-গুণ্ডামি চেতনা নিয়ে আমারা গড়ে তুলেছি আমাদের নিজস্ব পৃথিবী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আর দেশকে ভালবেসে আমরা যদি আমাদের চেতনা, চিন্তা আর ভাষা প্রকাশের সমন্বয় না করি, তবে আমাদের অনেক দুঃখ আছে।
মানুষ ও ঘটনা—
বিশ্বই আমাদের সবকিছু, এই হল ঘটনা। আমরা সবসময় ভাবি যে বিশ্ব হল বস্তুর সমষ্টি, কিন্তু আসলে বিশ্ব হল অনেকগুলো সত্য ঘটনার সমন্বয়। বিশ্বে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই আমাদের বলে দেয় কোন ঘটনা সত্য আর কোন্টা মিথ্যা। আমরা তাই বলতে পারি, আমাদের এই জগৎ হল অনেকগুলো ঘটনার যৌক্তিক অবস্থান৷ দার্শনিক লুদভিগ হ্বিটগেন্সটাইন তার বই ট্রাকটাটাস লজিকো ফিলসফিকাসেও এ কথা বলেছেন৷
আমাদের মনে রাখতে হবে, সময় আর স্থান একে অপরের সাথে জড়িয়ে দেশকাল বা Space Time হয়ে অবস্থান করে আর দেশকালের পরিবর্ত্তন সম্পর্কিত সবকিছুই হল ঘটনা। আমাদের জন্ম যেমন একটা ঘটনা, প্রতিদিনের জীবনযাপনও হল প্রতিদিনের ঘটনা, আর আমাদের মৃত্যুও একদিন ঘটনা হয়েই উপস্থিত হবে। এই যে আমরা পাহাড়, পর্ব্বত, সাগর, মহাসাগর, ঘর, বাড়ী, রাস্তা, ঘাট, হিংসা, বিদ্বেষ, রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা দেখছি, তার সবই কোন না কোন যৌক্তিক বা অযৌক্তিক অধ্যায়ের সত্য ঘটনা হয়েই অবস্থান করছে।
আমাদের বিশ্ব হল বাংলাদেশ। এই সময়ে দেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহের যৌক্তিক অবস্থান বিশ্লেষণ করে ঘটনার সত্যতা আমাদের নির্দ্ধারণ করতে হবে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, বাঙালী সব সময় সত্য আর মিথ্যাকে পাশাপাশি রেখে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করেছে। এমন ঘটতে থাকলে একসময় বাঙালীর সামাজিক অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে এক নতুন সত্য ঘটনার সৃষ্টি করবে। আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে পেয়েছি যে গত ৫০ বছরে বাঙালীর প্যারাডাইম (টমাস কুনের দর্শন দ্রষ্টব্য) পরিবর্ত্তন হয়ে যাচ্ছে। এই প্যারাডাইম বিবর্ত্তন একটী সাংঘাতিক ঘটনা। এখনই যৌক্তিক চিন্তা না করলে আমরা এক অযৌক্তিক সময় আর ঘটনার বিষয়বস্তু হব।
জীবন ও ছন্দ—
ছন্দহীন বিশ্বজগতের কথা আমরা চিন্তাও করতে পারি না। আমাদের এই পৃথিবী, মহাবিশ্ব, ভৌত ও জৈব জগৎ এবং কোয়ান্টাম বিশ্বসহ যে কোন জাগতিক ও মহাজাগতিক বস্তু, বিষয় বা ঘটনাকে বিশ্লেষণ করলে আমরা এক ধরনের যৌক্তিক গানিতিক ছন্দকে খুঁজে পাব। ছন্দ ছাড়া কোন বিষয় আমাদের জীবন ও প্রকৃতিতে নাই। যে মুহূর্ত্তে জীবন বা প্রকৃতির যৌক্তিক ছন্দ বিঘ্নিত হয়, ঠিক তখনই আমরা পাই পতিত ছন্দের সুনামি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, পাগলামি, ক্যান্সার ইত্যাদির মত ছন্দহীন অনুষঙ্গ।
মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সময়ে মায়ের হৃৎপিণ্ডের ‘লাব-ডাব’ শব্দ শুনতে শুনতে আমরা পৃথিবীতে আসি। তারপর ছেলেবেলায় শুনতে হয় ‘হাট্টিমা টিম টিম, তারা মাঠে পাড়ে ডিম’, ‘ঐ দেখা যায় তালগাছ, ঐ আমাদের গা’, ‘খোকন খোকন করে মা’য়, খোকন গেল কাদের নায়’ ইত্যাদি মত ছন্দ৷ মানুষ হিসেবে বড় হতে গিয়ে বুঝি হৃদয়ের ছন্দ, হেটে বেড়ানোর ছন্দ, কাজকর্ম্মের ছন্দ৷ আমাদের ঘুমানোর নিয়ম, খাওয়াদাওয়ার সময়, খরচের হিসাবপত্র এমনকি টয়লেটে যাবার সময়ও একধরনের পরিকল্পিত ছন্দ মেনে চলে৷
আমরা ছন্দপূর্ণ সামাজিক ভাষা বলতে বলতে সঙ্গীত আর কাব্যের জগতে প্রবেশ করি এবং এর ফলে একজন কবী বা গায়ক কিংবা লেখক সবসময় মনস্তাত্ত্বিক কারণে পরিকল্পিত ছন্দকে পছন্দ করে। এমনকি সব ধরনের গদ্যের মাঝেও এক ধরনের অন্তর্নিহিত ছন্দ থাকে। আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ হরমোন, এনজাইম, রক্ত সঞ্চালন, খাদ্য পরিপাক ও অন্যান্য সব ব্যাবস্থাই নির্দ্দিষ্ট ছন্দ মেনে চলে, ছন্দপতন হলেই আমরা হই অসুস্থ।
আমাসের সমাজ, রাজনৈতিক কর্ম্মকান্ড, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদিও কিছু নিয়ম আর অন্তর্নিহিত ছন্দ মেনে চলে। এই ছন্দ পতনের জন্য দায়ী দুর্নীতি, অবিচার, অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। যে কোন ছন্দপতন সমাজ, দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৃষ্টি করতে পারে দ্রোহ, আন্দোলন, দুর্বিক্ষ, যুদ্ধ ইত্যাদির মত ঘটনার।
আসল কথাই হল, জগৎ ও জীবন নিয়ম ও ছন্দ মেনে চলে। ছন্দ পতন হলেই যত গণ্ডগোল।
মঈন চৌধুরী রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত প্রবন্ধ, অল্পস্বল্প জীবন পাঠ — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।