Fascism এর বাংলা প্রতিশব্দ বলা যায় ফ্যাসিবাদ। এই শব্দের সাথে প্রায় সকলেই মোটামুটি পরিচিত। ফ্যাসিবাদ কাকে বলে সে সম্পর্কেও অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও তা চিহ্নিত করার মত জ্ঞান অনেকেরই আছে। Fascism শব্দের উৎপত্তি ইতালীয় শব্দ Fascio হতে, যার অর্থ Bundle বা Sheaf. এর থেকে বেশ বোঝা যায় Fascism হল একটা এক কেন্দ্রিক মতাদর্শ বা মতবাদ যা মূলত রাজনৈতিক মতাদর্শ ও আন্দোলন। ফ্যাসিবাদের বিকাশের সময় ১৯ শতকের শেষের দিকে পূর্ব্ব এবং দক্ষিণ ইউরোপে।
ফ্যাসিবাদকে রাজনৈতিক মতাদর্শগত আন্দোলন বলা হলেও তার দার্শনিক ভিত্তির পেছনে জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিৎসের ভূমিকা রয়েছে বলে অনেক গবেষক মনে করেন। ফ্রেডরিক নিৎসে ইউরোপের প্রচলিত ধর্ম্ম-বিশ্বাস ও ঐতিহ্যগত চিন্তাভাবনার মূলে আঘাত করেন তার নতুন দর্শন দ্বারা। তার দর্শনের প্রধান কেন্দ্র ব্যক্তী ও স্বাধীনতার প্রকৃতি ও ভাগ্য; তিনি ঘোষণা করেন ‘ঈশ্বর মৃত’। তাঁর দর্শনে তিনি এমন ব্যক্তির কথা বলেন যিনি হবেন সব দিক থেকে প্রজ্ঞাবান, শক্তিশালী ও সর্ব্ববিষয়ে অন্য যে কারোর চাইতে শ্রেষ্ঠ, যাকে তিনি বলেন ‘Ubermensch’। একক ব্যক্তির এই শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা ফ্যাসিবাদকে উৎসাহ যোগায়। বাস্তবেও আমরা দেখতে পাই ফ্যাসিবাদের প্রধান স্রষ্টা ইতালির একনায়ক বেনিতো মুসোলিনি ফ্রেডরিক নিৎসের খুবই অনুরাগী।
১৯ শতকের শেষের দিকে ইতালিয়ান বিপ্লবীরা Fascio শব্দ ব্যবহার করে নিজেদের সাথে কৃষক বিপ্লবীদের সংহতি প্রকাশ করে। ১৮৯৩-১৮৯৪ সালে সিসিলির কৃষক বিপ্লবী যারা ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে নিয়োজিত ছিল তারা তাদের আখ্যায়িত করতো Fasci Sicilians বলে।
কাগজে কলমে ফ্যাসিবাদের জন্ম মিলানে, ২৩ মার্চ, ১৯১৯ সালে বেনিতো মুসোলিনির হাত ধরে। এদিন একশরও বেশী লোক নিয়ে ফ্যাসিবাদী পার্টি গঠিত হয়,যার মধ্যে বেশীরভাগই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধা, এছাড়াও বুদ্ধিজীবী ও কিছু সাংবাদিক ছিলেন। এই ফ্যাসিস্ট পার্টি স্যোসালিস্ট ও উদারপন্থীদের বিরুদ্ধে সর্ব্বদা সোচ্চার থাকার কথা ঘোষণা করে, তারা বুর্জোয়াদেরও সমূলে উৎপাটনের ঘোষণা দেয়। ১৯১৯ সালের ১৫ এপ্রিল বেনিতো মুসোলিনির নেতৃত্বে স্যোসালিস্ট দৈনিক পত্রিকা Avanti অফিস আক্রমণ করে (১৯১২-১৯১৪ পর্য্যন্ত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন মুসোলিনি নিজেই), এতে চারজন নিহত ও বহু আহত হয়, ইতালিতে সহিংসভাবে আত্মপ্রকাশ করে মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী দল। ১৯২২ সালে ক্ষমতায় আসে বেনিতো মুসোলিনির দল। এর এগার বছর পর জার্মানিতে ক্ষমতায় আসে হিটলারের স্যোসালিস্ট নাৎসি পার্টি। চরিত্রগতভাবে দুই দলেরই মিল অনেক।
বেনিতো মুসোলিনি ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে শক্তিশালী অস্ত্রে রূপান্তরিত করেন, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ইতালির একমাত্র ত্রাতা হিসেবে। জার্মানিতে হিটলারও ঠিক একই কাজ করেন। ফ্যাসিবাদের জনক যদি হন মুসোলিনি, হিটলার তার সর্ব্বোৎকৃষ্ট লালনকারী ও ব্যবহারকারী। যদিও অনেকে মনে করেন হিটলারের অনুগামী ছিলেন মুসোলিনি, প্রকৃতপক্ষে হিটলারই মুসোলিনির অনুগামী।
ফ্যাসিবাদের উৎপত্তির পেছনের কারণ অনুসন্ধান করতে হলে তৎকালীন ইউরোপের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট খুব ভাল করে বুঝতে হবে! প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপ সব দিকে থেকেই ক্ষত-বিক্ষত। বিশেষ করে পরাজিত অক্ষশক্তির অবস্থা শোচনীয়। ভঙ্গুর অর্থনীতির অবস্থার মধ্যেও ইতালি ও জার্মানি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ মিত্রশক্তিকে দিতে বাধ্য হচ্ছে, দেশে বেকারত্ব বাড়ছে, অনাহারে মানুষ মারা যাচ্ছে। এই রাহুর গ্রাস হতে স্বভাবতই ইতালি ও জার্মানির নাগরিকরা মুক্তি চায়, কিন্তু চাইলেই তো তা সম্ভব নয়। ক্রমে ক্রমে স্যোসালিস্ট ও লিবারেল রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে মতবাদ গড়ে উঠতে থাকে, বিশেষত স্যোসালিস্টরা যেহেতু জাতীয়তাবাদ বিরোধী তাদের বিরুদ্ধে সহজেই জনমত গড়ে তোলা হয় জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডা তুলে। ইউরোপে তখন ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করত ইহুদীরা, যেহেতু ইহুদীরা ইউরোপে অভিবাসী, তাদের বিরুদ্ধেও ফ্যাসিবাদী রাজনীতি শুরু হল জাতীয়তাবাদের নামে, তাদের বিরুদ্ধে সমগ্র ইউরোপেই বিদ্বেষ ও ঘৃণা বাড়তে লাগল। মুসোলিনি ও হিটলার এই ঘৃণাকে অন্যতম পূঁজি হিসেবে নিয়ে এ্যান্টি-সেমিটিক মনোভাব গড়ে তুললেন। সাধারণ নাগরিকরাও ইহুদী বিদ্বেষী হয়ে উঠলো। পুরো ইউরোপ জুড়েই ইহুদীদের বিরুদ্ধে বিষেদাগার চলল, কোথাও সরবে কোথাও নিরবে। ফ্যাসিবাদে এই ছোট ছোট ছোট বিষয়গুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ, বিদ্বেষ বা ঘৃণা সমাজে ছড়ানোর সহজ একটা পন্থা হচ্ছে রাজনীতির মাধ্যমে আদর্শিক বিভাজন তৈরি করা। মুসোলিনি তার সমস্ত বিরুদ্ধ পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেন বা গোপনে হাত করেন, কিন্তু হিটলার এককাঠী সরেস, তিনি তা যা করেন তা সরাসরি করেন, তার গোপন পুলিশবাহিনি গেস্টাপোর মাধ্যমে সকল প্রতিপক্ষ ও বিরুদ্ধবক্তাকে রাতের আঁধারে মেরে ফেলতেন। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেবার প্রচেষ্টা পুরোপুরিভাবে কার্য্যকর হয়েছিল হিটলারের জার্মানিতে। হিটলার তার এসব কাজে প্রচুর সহযোগিতা ও উৎসাহ পেতেন তার প্রচারমন্ত্রী ও তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী জোসেফ গ্যেবলসের, গ্যেবলস বলতেন সকল মন্দ কাজের দায় চাপানো হবে বিরোধী পক্ষের ওপর, সকল ভালো কাজ করে তার দল আর সকল খারাপ কাজ করে বিরোধী দল। ফ্যাসিবাদী রাজনীতি খুব জোর দেয় জাতীয়তাবাদের ওপর, এই জাতীয়তাবাদ হতে পারে জাতিগত, ভাষাগত বা সংস্কৃতিগত। বিরোধী কোন মত বা আদর্শের কোন ঠাঁই নেই ফ্যাসিবাদে। ফ্যাসিবাদ চায় একক আধিপত্য ও একক নিয়ন্ত্রণ। স্বতই এক্ষেত্রে সহায় হয় গ্যেবলসের মত কিছু লোক, যারা সকল কিছু চোখের পলকে পাল্টে ফেলতে পারে।
Fascism-এর আদর্শ ও চরিত্র নিয়ে বিশ্বে বিস্তর গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে, প্রায় প্রতিটি ফ্যাসিবাদী শাসক নিজের কাজকে অনিবার্য্য হিসেবে দেখে। ফ্যাসিবাদের মৃত্যু হয়েছে বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, প্রকৃতপক্ষে ফ্যাসিবাদ অমর! যতদিন না মানুষ নিজের ও অন্যের স্বাধীনতা নিয়ে ভাববে ততদিন তা দূর হবে না ফ্যাসিবাদ। মতপ্রকাশের ও চিন্তার স্বাধীনতা মানবজাতির অগ্রগতির মূলে রয়েছে। তাই চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে মানুষের অগ্রগতিই থেমে যাবে একথা নিশ্চিন্তে বলা যায়। পরস্পরের প্রতি সহনশীল মনোভাব লালন ও বিরুদ্ধ মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা মানুষ হিসেবে সবারই থাকা উচিৎ। ফরাসী লেখক ভলতেয়ারের উক্তি এক্ষেত্রে স্মরণীয়—
“I disapprove of what you say, but will defend to the death your right to say it.”
চলন্ত সরকার রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গদ্য, ফ্যাসিবাদ — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।