গল্প ইমসোমনিয়া

৪০ সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ মুসাকে ৪০ রাতের ওয়াদা করেছিলেন। ইলিয়টের কাছে কবিতার দীক্ষা নিতে এলে উনি একজনকে উপদেশ দেন ৪০ বছর পর আসার জন্য। মানে চল্লিশ না হলে মানুষ পরিপক্ব হয় না। নবিজীও নবুয়ত পেয়েছেন ৪০ বছরে। ৪০বছরে মানুষ ভিন্ন মাত্রার জগতে প্রবেশ করে। টাকা, বাড়ী করার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক চিন্তাও ভর করে। সমাজে নিজেকে আলাদা করে আত্মপ্রকাশ করার জন্য দান খয়রাতও করে, কেউ কেউ রাজনীতিতেও যোগ দেয়। ধীরেধীরে নতুন মাত্রা যোগ করে। আমলা; যার আরবী মানে গোলাম, খেদমত করা। তারাও ৪০-এ এসে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে কীভাবে সমাজে অন্যের চেরে আরও উপরে যাওয়া যায়। নিজেরা সরকারি চাকরী করলেও বাচ্চাদের জন্য প্রাইভেট স্কুল, কলেজ ব্যবস্থা করে। বউয়ের জন্য আলাদা গাড়ী কলিকেতায় গিয়ে বেড়িয়ে এসে দামী শাড়ী এনে উপহার দেয়। স্ত্রী তার বান্ধবীদের গর্ব্ব করে বলে “My husband is so sweet! বান্ধবীরা হীনমণ্যতায় ভোগে, কারণ তাদের স্বামীদের এতকিছু করার ক্ষমতা নেই।

কিন্তু রঞ্জুর ৪০ বছরে এসে অনিদ্রা, মৃত স্ত্রীর স্মৃতি আর দুটো সন্তানদের দায়িত্বের আশীর্বাদ কপালে জুটেছে। বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে রঞ্জু প্রবেশ করে তার আপন ভুবনে— বালিহাঁসের এক নি:সঙ্গ অভিযান। অবশ্য ঘুম না আসা রঞ্জুর জন্য ভাল। সে চিন্তা করতে পারে একটানা। মেডিটেশন, ঘুমের ঔষুধপাতি খেয়ে মুক্তি পেতে চায় না।

“নিস্তব্ধতাই ঈশ্বরের নিজস্ব ভাষা। বাকিসব এর দুর্ব্বল অনুবাদ।” রুমীর এ কথাটা ভাবতে ভাল লাগে রঞ্জুর। রঞ্জু রাত্রির এই বিস্তব্ধতাকে তর্জ্জমা করে।

তাছাড়া চিন্তা করাই এখন তার একমাত্র কাজ। দেকার্তে নাকি ঘুমের মাঝে চিন্তা করতে করতে বড় বড় দার্শনিক সমস্যার সমাধান করেছেন। তিনি নামও রেখেছেন meditation 1, meditation 2. আইনস্টাইনকে একজন বলেছিল “আপনার এত মেধা কীভাবে এল?” তিনি বিনয়ভাবে উত্তর দিলেন” ‘দেখুন, আমি স্কুলে এক মাঝারী মানের ছাত্র ছিলাম। তবে আমি ঘন্টার পর পর নিরলসভাবে চিন্তা করতে পারি।’ দস্তয়ভস্কির এক গল্পের চরিত্রকে জিজ্ঞেস করা হয় “কোন কিছু না করে কীভাবে কেটে যাচ্ছে জীবন?” উত্তর আসল “আমিও একটা কাজ করছি। সেটা জগৎ, জীবন আর প্রকৃতি নিয়ে ভাবা”

রঞ্জুও প্রাত্যহিক কাজ শেষে রাতে শুধু ভাবে। তার ভাবনা শুধু দার্শনিক বা বুদ্ধিভিত্তিক নয়। সে ভাবে সেই বৃষ্টির দিনের কথা, যেদিন তার মা গেইটে দাঁড়িয়ে ছিল— বলেছিল, ‘আজ ঢাকা যাসনি?’ সে রাত রঞ্জুর ঘুম হয়নি। সে বুঝতে পেরেছিল কিছু একটা অঘটন ঘটবে। পরেরদিনই ফোন আসে তার মা হার্ট এ্যাটাকে মারা যায়।

লাতিন আমেরিকার উপন্যাসে যাদুবাস্তবতা দেখান মার্কেজসহ আরো অনেকই। রুশদীও ‘মিডনাইট চিলড্রেন’-এ দেখান কিছু ছেলে যারা ৪৭/৪৮-এ দেশভাগের সময় জন্মায়, তাদের কিছু অলৌকিক ক্ষমতা আছে। হুমায়ুনের চরিত্রের মাঝেও ESP ক্ষমতা আছে বলে দেখতে পাওয়া যায়। তারা অনেককিছু জানে।

রঞ্জুর এইসব কোন ক্ষমতা নেই। তবে সে তার আপনজন কেউ মারা যাবার আগে বুঝতে পারে। এটাকে না কি dream premonition বলে। তার খালাত ভাই মারা যাবার আগেও স্বপ্নে দেখত তার প্রিয় কাকে যেন গোরস্তানে নেয়া হচ্ছে। গোরস্তানের পাশে একটা বড় ঈদগাহ মাঠ। যেটা ছিল রঞ্জুর খালার বাড়ীর এলাকার। বুঝতে বাকী রইল না অসুস্থ খালাত ভাইয়ের কিছু হতে যাচ্ছে।

সত্যিই কি জগতে এমন কিছু ঘটে যা আমাদের লজিকের বাইরে। হেমলেট কি হোরাশিওকে এটাই বলতে চেয়েছিল। রঞ্জুর ভাবনায় আসে তার স্ত্রীর কথা যে মোটেও সুখ পায়নি। পার্থিব চাহিদা সব মেটাতে পারেনি রঞ্জু। তারপরও কোন অভিযোগ ছিল না তার। প্রভু তাকে নিয়ে গেল কেন? তার সন্তানরা অন্যের মায়ের আদর দেখলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। প্রকৃতি ইচ্ছে করেই মানুষকে অসুখী রাখে। রঞ্জুর বান্ধবী যার জন্য একসময় সে পাগল ছিল, তার স্বামী পঙ্গু। বাচ্চা হয় না। সে তো একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষকে বিয়ে করেছিল। তাহলে তার জীবনে কেন এই ভয়বহ পরিণতি। সে এ জীবন মেনেও নিয়েছে। অথচ কথা ছিল ছায়া হয়ে পাশে রইব একজন আরেকজনের। রঞ্জু ক্লাসমেট বলে বান্ধবী আলেয়া তাকে বিয়ে করেনি। আসলে মানুষ একভাবে ভাববে প্রভু আরেকভাবে নিয়তি তৈরী করে রাখে। রঞ্জু pre-determination থিওরীতে বিশ্বাস করত না। কিন্তু “our thoughts are ours but their ends are not ours” Shakespeare তো বলেই গিয়েছেন। এত ভাবনার পরও রঞ্জুর ঘুম আসেনি।

রঞ্জু ভাবতে লাগল মানুষের অনেকগুলো জীবনের অপশনস থাকা উচিৎ ছিল। এক জীবনে বৈরাগী, অন্য জীবনে একজন অনুগত গেরস্ত, কিংবা প্লেটোর মত সেলিবেসি জীবন কাটিয়ে দেখা যেত— কোন্ জীবনটা বেশী কাম্য। আপসোস মানুষকে এই অতৃপ্তি নিয়ে মরতে হয়। সবাই একটা আংশিক সত্য নিয়ে জীবন কাটায়।

একটা পিঁপড়াকে একটা সুতোয় ছেড়ে দিলে যদি অন্যত্র না যাবার ব্যবস্থা করা হয় তাহলে তার জগৎটা মনে হবে শুধু সুতোর দৈর্ঘ্য। কোন ব্যস, তল, ঘণত্ব নেই। একমাত্রিক একটা জগৎ। রঞ্জুরও তাই। সে ভাবে তার জগৎ একমাত্রিক। শুধু দৈর্ঘ্য বরাবর সামনে হাটা কিংবা গিছনে স্মৃতিতে ভেসেবেড়ানো।

বহুমাত্রিক জগতের কথা অধুনা বিজ্ঞানে শুনতে পাওয়া গেলেও এই পৃথিবীতেই মানুষ বহুমাত্রিক জীবন কাটায়। আপনার টাকা পয়সা, বিত্ত, বৈভব যত বাড়বে ততই নতুন মাত্রা যোগ হবে। আর রঞ্জুর হচ্ছে উল্টো। তার মা, স্ত্রীর বিয়োগ, তাকে একমাত্রিক জগতের বাসিন্দা বানিয়ে ফেলল। সে সমাজে থেকেও যেন নেই। একজন outsider— রবিনশনের মত আধুনিক মানুষকে কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করতে হয় না। সে solitude in multitude এই বোধের ভেতর জীবন কাটায়।

রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গল্প, ইমসোমনিয়া — তে সম্পাদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *