Absurd এর বাঙলা প্রতিশব্দ উদ্ভট। সঙ্গীতের ভাষায় Absurd অর্থ বেসুরা। সাহিত্যে Absurd তত্ত্ব জনপ্রিয়তা পায় নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেটের (১৯০৬-১৯৮৮) মাধ্যমে। এছাড়াও ইউজিন আয়োনেস্কো, আর্থার এ্যাডামভ, এডওয়ার্ড এ্যালবি, হ্যারল্ড পিণ্টার, ফার্নান্দো এ্যারাবাল Absurd নাটকের ধারায় প্রধান নাট্যকার। তবে Absurd নাটককে তত্ত্বাকারে প্রতিষ্ঠা দেন হাঙ্গেরীয় সমালোচক মার্টিন এসলিন (১৯১৮-২০০২) তাঁর The Theatre of The Absurd (1962) গ্রন্থে। তাঁর মতে Absurd নাটক হল “Out of harmony with reason or prosperity; Incongruous, unreasonable, illogical.”
[The Theatre of Absurd]
ইউজিন আয়োনেস্কোর (১৯০৯-১৯৯৪) মতে Absurd হল সমস্ত উদ্দেশ্য ও সংকল্প থেকে বিচ্যুতি, ধর্ম্ম কিংবা প্রচলিত স্বাভাবিক ধ্যানধারণা, অধিবাস্তবতা ও অলৌকিকতার মূল থেকে বিচ্ছিন্নতা। Absurd বিশ্বে তালভ্রষ্ট মানুষের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ অসংবেদী, অযৌক্তিক, কার্য্যকারণহীন। তাঁর ভাষায়—
“Absurd is that which is devoid of purpose… Cut off from his religious, metaphysical and transcendental roots, man is lost; all his actions became senseless, absurd it, useless.”
[The Theatre of Absurd]
Absurd নাটকের সাধারণত দুইটা তল থাকে। উপরিতলে থাকে জীবনের অসঙ্গতির অসংলগ্ন প্রকাশ ও অন্তর্তলে নিহিত থাকে মানুষের নির্ভরতহীন অনিকেত জীবনের গভীর Absurdity.
Absurd নাটকের মৌল বৈশিষ্ট্য বলা যায়— অন্তহীন অর্থহীন ব্যর্থ প্রতীক্ষা। বিজ্ঞান নির্দ্দেশিত যৌক্তিক বিশ্বের ‘Space and Time’ Absurd নাটকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত, মানুষের স্বাভাবিক যুক্তিবোধ ও ঘটনার পারম্পর্য্য ও ধারাবাহিকতা Absurd নাটকে নেই। বিপরীতে লক্ষ্য করা যায় ঘটনার বিচ্ছিন্নতা, আচমকা কোন কিছুর সন্নিবেশ। এ ধারার নাটকে চরিত্রের পরিবর্ত্তন নেই, সংলাপ অসংলগ্ন ও অর্থহীন, যেন সময় কাটানোর জন্যই চরিত্রগুলো কথা বলে। উপরন্তু লক্ষ করা যায় ঘটনার ও সংলাপের পৌনঃপুনিকতা।
স্যামুয়েল বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গডো ‘নাটককে কবীর চৌধুরী বলেছেন “রূপকাশ্রয়ী প্রতীকধর্ম্মী।’’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্ত্তী সময়ে মানুষের যে হতাশা, বিষন্নতা, অর্থহীনতা, নিরালম্ব প্রতীক্ষা তাই মূর্ত্ত হয়ে ওঠেছে এই নাটকে। নাটকে দেখা যায় শেষ পর্য্যন্ত কিছুই ঘটে না! গডো কথা দিয়েও আসে না। ভ্লাডিমির ও এষ্ট্রাগন চলে যাবার কথা বলেও পূর্ব্বের সেই স্থানেই বসে থাকে। Absurd নাটকের মূল যে বৈশিষ্ট্য অন্তহীন অর্থহীন প্রতীক্ষা তা এ নাটকেরও মূল বৈশিষ্ট্য বা বিষয়।
“ভ্লাডিমির : কিডনির জন্য খেতে হয়। এবার কী করব আমরা?
এষ্ট্রাগন : অপেক্ষা করব।”
[ওয়েটিং ফর গডো]
সাঈদ আহমদের ‘কালবেলা’ নাটকেও দেখা যায় অর্থহীন অপেক্ষা। প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যেই অ্যবসার্ড নাটকের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। জীবনে প্রকৃতপক্ষে কিছুই ঘটে না, কিন্তু তবুও মানুষ অপেক্ষা করে, যা আসলে ব্যর্থ প্রতীক্ষা। ‘ওয়েটিং ফর গডো’ নাটকে ভ্লাডিমির ও এষ্ট্রাগন অপেক্ষা করে গডোর জন্য আর ‘কালবেলা’ নাটকে সকল চরিত্র প্রতীক্ষা করে “খবর” এর জন্য।
“মোড়ল : কোন খবর?
আহাম্মদ : কোন খবর নেই।
মোড়ল : ঐ হল, ওটাও একটা খবর।”
[কালবেলা]
অন্যত্র সময়ের মাত্রাহীনতা ও অন্তহীন প্রতীক্ষার কথা আছে—
“মোড়ল : সময় জিনিসটাই ফাঁপা।
আহাম্মদ : প্রতীক্ষায় ক্ষয়ে যাচ্ছি আমি।
মোড়ল : তা একদিন ঘটবেই, কোন একদিন।”
[কালবেলা]
সময় সম্পর্কে মোড়লের ধারণা হল সময় ফাঁপা ও “সময় তো শুধু মুখোশ।”
‘ওয়েটিং ফর গডো’ নাটকে সংলাপ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, আবার কোথাও কোথাও দীর্ঘ, যেন জীবনের অর্থহীনতারই প্রতীক এই সংক্ষিপ্ত ও দীর্ঘ অসংলগ্ন সংলাপগুলো! ভ্লাডিমির ও এষ্ট্রাগন কথা বলে, কিন্তু তা যুক্তিহীন, পারম্পর্য্যবিহীন, অবান্তর ও হাস্যকর। এসব সংলাপ জীবনের অনন্ত প্রতীক্ষার পথে অভ্যাসের অনুকরণরূপে উপস্থিত। কারণ, তারা নিজেরাও জানে না কেন তারা এসব বলছে। ঠিক যেমন মানুষ নিজেও জানে না কেন সে তার দৈনন্দিন জীবন নির্ব্বাহ করে চলেছে।
“এষ্ট্রাগন : যেহেতু আমরা নীরব থাকতে অসমর্থ, অতএব ইতিমধ্যে একটু শান্তভাবে আলাপ করার চেষ্টা করা যাক।
ভ্লাডিমির : ঠিক বলেছ, আমরা অফুরন্ত।
এষ্ট্রাগন : যুক্তি আছে আমাদের।
ভ্লাডিমির : পাখার মত শব্দ করে তারা।
এষ্ট্রাগন : পাতার মত।
ভ্লাডিমির : ওরা সবাই, একসঙ্গে কথা বলে।
এষ্ট্রাগন : প্রত্যেকে নিজের নিজের সঙ্গে।”
[ওয়েটিং ফর গডো]
‘কালবেলা’ নাটকে মোড়ল, আহাম্মদ, মুনীর ছেলেবেলার কথা স্মরণ করে, তখন মোড়ল বলে— “ঠিক, একটা খেলা এসেছে মাথায়। … (অদ্ভুত আওয়াজ করে, হু-উ-ই-ই এই রকম পুরানো পরিচিত শব্দ সব। হাত দিয়ে শক্ত একটা কিছুকে যেন আঘাত করল) সব সময়ই আমার কাছে হেরে গিয়ে কেঁদে ফেলতে তুমি।”
[কালবেলা]
এ সংলাপ যেমন অর্থহীন ও বিষয় বিবেচনায় অপ্রাসঙ্গিক তেমনি ‘ওয়েটিং ফর গডো’ নাটকে এষ্ট্রাগনের টুপী নিয়ে কার্য্যকলাপও অর্থহীন।
“এষ্ট্রাগন ভ্লাডিমিরের টুপী হাতে নেয়, ভ্লাডিমির লাকীর টুপী নিজের মাথায় ঠিক করে বসায়। এষ্ট্রাগন নিজের টুপীর বদলে ভ্লাডিমিরেরটা পরে।”
[ওয়েটিং ফর গডো]
এভাবেই চলতে থাকে টুপী নিয়ে তাদের খেলা।
ওয়েটিং ফর গডো নাটক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের প্রেক্ষাপটে রচিত। এই করাল যুদ্ধ ইউরোপীয় মননে যে দাগ কাটে তারই প্রকাশ যেন এ নাটক! প্রতিটী মানুষের উৎকণ্ঠা, নিরালম্বময়, অর্থহীন, অনিকেত উৎকট জীবনের রূপায়ন যেন এই নাটক। প্রতিটি মানুষ পীড়িত অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করছে, পরিশেষে মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছে, এটাই যেন তাদের নির্ম্মম নিয়তি। সেই পীড়িত মননের উপলব্ধি যেন এষ্ট্রাগনের সংলাপে মূর্ত্ত হয়ে ওঠে— “আমরা সবাই ভূমিষ্ট হই উন্মাদরূপে। কেউ কেউ তাই থেকে যাই।”
আবার ভ্লাডিমিরের সংলাপে একই বক্তব্যের পরিচয় মেলে— “অস্বীকার করার উপায় নেই যে উই আরো বোরড টু ডেথ।”
[ওয়েটিং ফর গডো]
‘কালবেলা’ আসন্ন ঝড়ের প্রেক্ষিতে রচিত নাটক। এ নাটকে নাট্যকারের দর্শন ইতিবাদী। তিনি চরিত্রে ও ঘটনায় Absurd বৈশিষ্ট্য তুলে ধরলেও জীবনকে সরাসরি Absurd বলেননি। জীবনে Absurdity অনেক অনেক আছে সত্যি কিন্তু সেখান থেকে উত্তরণও ঘটে অনেকের। জীবন মহামূল্যবান, সাঈদ আহমদ এই মতে আস্থাশীল। ‘কালবেলা’ নাটকে উপেং বলে— “আমাদের একটা মাত্র জীবন। শুধু একটাই। দু’হাতে আমরা ধরে রাখবো জীবনকে। উন্মাদের মত ছুটোছুটি করে হারাতে চাই না জীবন।”
সাঈদ আহমদ ও স্যামুয়েল বেকেট দুইজনেই Absurd ধারার নাটকের বৈশিষ্ট্য যা কিছু তার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন নাটকে। কিন্তু জীবনদর্শনে তারা দুইজন দুই ধরণের মতবাদে আস্থাশীল। সাঈদ আহমদ দেশীয় প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্য তত্ত্ব অনুসরণে জীবনকে মূর্ত্ত করেন এবং তা অনেকাংশে উপমহাদেশীয় বাতাবরণে। আধুনিক জীবনের অত্যন্ত কদর্য্য রূপ ভারতীয় বা উপমহাদেশীয় মানসের অভিজ্ঞতার অতীত অনেকাংশেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই সাইদ আহমদ ইতিবাদী। বিপরীতে, ইউরোপ প্রত্যক্ষ করেছে আধুনিক যুগেই দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধ ও মারণাস্ত্রের ভয়ংকর ব্যবহার ও মানবতার চূড়ান্ত সমাপতন। তাই অভিজ্ঞতা ও পরিবেশ প্রভাবেই স্যামুয়েল বেকেট জীবনে ক্লেদ, হতাশা, অর্থহীনতা, বন্ধ্যাত্বের আতিশয্য দেখতে পান। স্বভাবতই তাঁর সৃষ্টিকর্ম্মে তারই রূপ প্রতিফলিত হয়েছে, যা চূড়ান্তভাবে নেতিবাচক ও ক্ষয়িষ্ণু।
মার্টিন এসলিন নির্দ্দেশিত Absurd নাটকের অনেক বৈশিষ্ট্য ‘ওয়েটিং ফর গডো’ ও ‘কালবেলা’ নাটকে উপস্থিত। তবে ‘ওয়েটিং ফর গডো’ প্রকৃতপক্ষেই জীবনের Absurdity-কে ধারণ করেছে অত্যন্ত সফলতার সাথে। কিন্তু ‘কালবেলা’ Absurd নাটকের বৈশিষ্ট্য নিয়েও শেষ পর্য্যন্ত Absurd নাটক নয়, বরং বলা যায় তা অনেকাংশে অ্যাবসার্ডধর্ম্মী নাটক, তার কারণ, নাট্যকারের জীবনদর্শনের ইতিবাচকতা।
সহায়ক গ্রন্থ/উৎস :
- প্রসঙ্গ নাটক— কবীর চৌধুরী
- অ্যাবসার্ড নাটক : আণুবীক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ও বাংলাদেশ— তারানা নূপুর
- স্যামুয়েল বেকেট- বীতশোক ভট্টাচার্য ও সুবল সামন্ত সম্পাদিত
- The Theatre of Absurd— Martin Esslin
- পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা— নবেন্দু সেন সম্পাদিত
- বাংলাদেশের থিয়েটার— নৃপেন্দ্র সাহা সম্পাদিত
চলন্ত সরকার রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত গদ্য, অ্যাবসার্ডিটীর আলোকে ‘ওয়েটিং ফর গডো’ ও ‘কালবেলা’ — প্রকৃতিপুরুষ বানান রীতিতে সম্পাদিত।