মায়া শহরে মধ্যরাত
মধ্যরাতের মায়া শহরে হেঁটে যাই …
আছড়ে পড়ছে এজটেক ড্রাম বিটস
নৃত্যপর উচ্ছ্বাস লোহিত কণিকায়
চোখ ধাঁধাচ্ছে ক্রিষ্টাল বলের বিচ্ছুরণ
তুমি সাথে থাকলেই উৎসব!
জেগে ওঠে প্রাচীন কলরব …
জাগরণ কড়া নাড়ে ঘুমের দরজায়
স্পর্শের মত দূর … নিঃশ্বাসের সন্নিকট!
তুমি সাথে থাকলেই নীল সাঁতার …
ব্রহ্ম মুহূর্ত ছুঁয়ে দেওয়া সকাল
পেয়ে যায় রমণীয় ভোরের সন্ধান
তুমি সাথে থাকলেই উপকথাগুলোয় প্রাণ!
হতে পারে এই গল্প তোমার এবং আমার
কেউ স্বত্ত্ব দাবী করলে তবু দিয়ে দেব শর্তহীন!
আয়না আখ্যান
তোমাদের সদরে কাঠের দরজায়
পারদ ওঠা আয়নাটা, মনে আছে?
প্রতিবার ঘরে ঢোকার মুখে চোখাচোখি
মুখ দেখার নেশায় প্রায়-ই চৌকাঠে হোঁচট
ঝাপসা আবছায়া, কখনো আমি
কখনো তুমি আমি, মুখভঙ্গিতে কত রং
সময় আস্তে আস্তে ডানা পেল
দূরত্ব-ও পেল, হয়ত ওড়বার আকাশ,
খানিক ভাংচুর ও পেয়ে গেল কুড়িয়ে কুড়িয়ে …
ম্যাট ফিনিশ মেটাল ওয়ার্ক্স এর ফ্রেমে
চমৎকার আয়নাটা সিঁড়ির ল্যান্ডিং জুড়ে
গভীরে প্রতিবিম্বিত বাড়ীর রুচিশীল ডেকোর
আয়না মহলে বসতি, বলতে পার
টুকরা টুকরা ‘আমি’ প্রতিবিম্বিত সারা বাড়ী
চেনা এবং অচেনা, জুড়ে জুড়ে আয়না আখ্যান!
দূর পেরুনোর গান
জীবন, তুমি দূরগামী ভায়োলিন
বিরহ কিংবা দূরত্ব পেরুনোর ভ্রমণ
যাপন, তুমি কেবল পেরিয়ে যাওয়া …
দূর এবং নিকট, শুধু ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত
পরিবর্তন-ই মেলায় সকল সমীকরণ
জীবন, তুমি নৈকট্যের ছড় টানা সুর
অসীমের এককে দূরত্ব মাপছ যখন
এইসব চলে যাওয়া, এইসব বিদায়
প্রতিশ্রুত ফেরার অঙ্গিকার, যেমন বলে সবাই
সূর্য ডুবে গেলে রাত্রিঘুম যেভাবে সকাল ছোঁয়
রিয়ার ভিউ মিররে হাত নাড়ছ তুমি
ছোট হতে হতে বাঁক নেয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত
এই তো সাথেই ছিলে, চাকাগুলি ঘুরে যায়
ডিজিটাল মাইলেজ কি করে জানবে বল
দূর পথ কিভাবে পৌঁছে যায় নিকট ঠিকানায়!
মেলা ভাঙার পর
ভাঙা মেলার ধুলা উড়ছে খর হাওয়ায়
আতশবাজির ছাইয়ে ঈষৎ বারুদ গন্ধ
একটা শূন্যতার মতন সকাল ফুটছে …
শেষ রাত্রে জোর হাওয়া দিয়েছিল
হাওয়ায় চুল উড়িয়ে চলে গেছে বাউল
রেশটুকু আছে কি নেই, সুরের নেশার …
ইতস্তত পায়ের ছাপ, টায়ারের দাগ
গুটিয়ে ফেলা প্যাণ্ডেল, তেরপল
বলে যায়নি সে, পরবর্তী গন্তব্য
কোন জমায়েত কিংবা রঙের আসর
একটু হাহাকার মতন, ভুলে যাবার ছলে
সঙ্গোপনে সঙ্গে নিয়ে বুকের ভেতর …
মেলা ভাঙা সদ্য ইউফোরিয়ার তীরে
তিরতির বিষাদ, উন্মনা মেঘের ছায়ায়
এক ঝাপটা বৃষ্টি আজ আসুক নাহয়!
নির্বেদের ভিতরে
নিদ্রা নয়, নির্বেদ
সন্ধ্যে গাঢ় হলে
একান্ত কোটরের আলোছায়া
সময়কে বলি, নত হও …
সময়কে বলি, আপ্লুত জলধারা হও …
ভুলগুলি ফুল হয়ে রাতের উঠোনে
ঝড়ো সকাল উড়িয়ে নিক মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে
নক্ষত্রদের পরস্পর দেখা হয়ে যায় দৈবাৎ
হয়ত অযুত আলোকবর্ষে মাত্র একবার
তারপর যে যার কক্ষপথে …
হতে পারে শুধু দূর আকাশ জানে
দুই একটা দ্যুতিময় গল্প
আলোর অক্ষর আঁধারের স্লেটে …
নির্বেদের ভেতরে স্বপ্নাচ্ছন্ন জেগে থাক
ভুলে ফুলে পলকে পেরুনো একটা জীবন
আত্মজার আয়নায়
এই যে সন্ধ্যে নামছে আলতো ডানায় …
গোলাপী গোধূলিতে মিশে যাচ্ছে ধূসর
কফি কাপে টুংটাং চামচ, হাফ এণ্ড হাফ
মিশে যাচ্ছে প্রিয় ব্লেণ্ডে, ধোঁয়ায় আমন্ত্রণ
একটা গাঢ় চুমুক, একটা লম্বা দিনের শেষে …
পর্দার ভাঁজে থমকে ছিল শেষ বিকাল
সান্ধ্য জানালায় উড়ে এল নস্টালজিয়া
মায়ের শাড়ীতে সাজতে সাজতে
আয়নায়, কাজল লেপ্টে যেতে চায়!
কেন যে জল আসে চোখের নিবিড়ে …
মা, সুরমা রং শাড়ীতে মায়াবী চোখ
পারদের ওপারে অপলক
পারফিউম স্প্রে করতেই ঘোর কেটে যাচ্ছে!
ফরাসী সৌরভে চমকে ফিরে আসছে
এই ক্ষণ, স্মৃতি পেরিয়ে তোমার নিমন্ত্রণ!
রাত্রি কাহন
তোমার শহর রাত্রিব্যাপী আলোয় ধোয়া
আমার শহর ভাবছে, না হয় ঘুমিয়ে পড়ি
জানালা গলে চাঁদের আলোর মিহিন ঝুরো
গুঁড়ো গুঁড়ো ভালোবাসা ছড়িয়ে দিলো …
ঘুম শহরে ভাবনা ভ্রমণ, খানিক দূরেই
এক লহমায় তোমার শহর, স্বপ্নে দেখা
যদিও তুমি ঘুমের গভীর, সন্ধ্যে হতেই
নিবিড় রাতে আমার অতল ইনসমনিয়া!
হঠাৎ কোন ম্যাজিক বিকাল, আবির রাঙা
দরজা খুলেই চোখের তারায় আলোর ছটা
বাড়ানো দু’হাত উষ্ণ তুমুল আমন্ত্রণের
বিকালগুলি গোধূলি মাখে সন্ধ্যে ছুঁয়ে!
বৃষ্টি মুখর রাত্রিগুলোয় কথার ঝুড়ি
উপচে পড়া উচ্ছলতার ছলাৎ ছলাৎ
তোমার আমার স্বপ্নগুলো পরস্পরে
মিহিন সুতোর গল্প বোনে ঘুমের ওমে …
মেলানকলিয়া
খুব ক্লান্তি চলে এলে চুপচাপ
বসে থাকি নিরিবিলি ঐ কোণে
বসে বসে ঝিম মেরে থাকা
রৌদ্রময় দিন পিছলে চলে যায়
বন্ধ চোখের দৃষ্টি দিয়ে এভাবেও দেখা যায় …
ক্লান্তি এবং নির্বেদ পরস্পর সমঝোতায়
স্থবির দেখে যাওয়া, পৃথিবী খুব তাড়া নিয়ে
আহ্নিক গতিতে চলে যাচ্ছে সম্মুখে
মাঝে মাঝে অপার ক্লান্তির সীমানায়
এইভাবে চুপচাপ বসে থাকা মন্দ নয় …
যতিচিহ্নের মত এইসব বসে থাকা
থমকে যাওয়া কিংবা শ্লথ থেমে যাওয়া
বন্ধ চোখ ধীর প্যানোরোমিক দেখছে
অন্তর্মহলের আকাশজোড়া মেলানকলিয়ায়
স্তবক স্তবক মেঘফুল বর্ষণের অপেক্ষায় …
প্যাণ্ডোরা ব্রেসলেট
প্যান্ডোরা ব্রেসলেট, এবারের উপহার
এক একটা বিড, নামের আদ্যাক্ষর
নন্দন নক্সা কিংবা প্রিয়তম অক্ষর
ডাকনাম দিলাম, বেদনা ক্রিষ্টাল …
কী অনায়াস কেতায় দিয়ে দাও!
প্যাণ্ডোর বাক্সে জমিয়ে রেখেছি
গূঢ় এক একটা ভাব-অনুভব
মাঝে মাঝে মিলিয়ে দেখে নিই
ক্রিস্টালগুলির সাথে মিলে যায়
ঝিকিমিকি, বাহারী, আলোর নীচে
আলোর হেরফেরে ক্যামেলিয়ন সুখ-দুঃখ
প্যাণ্ডোরা ব্রেসলেট গাঁথে নতুন বিডস
কী নামে ডাকি, এইসব উপহার, মন ভার
পারছে না জ্বালাতে আলো-ভোর আর!
এক একটা উপলক্ষ, মেঘ-ঝড়-জল প্রাক পর্ব
প্যাণ্ডোরা ব্রেসলেট, দুঃখ টলটল অলঙ্কার …
সুতায় বাঁধা দিন
ছায়াবাজির পুতুল চাইলে, সুতায় বাঁধা দিন
আগ্রাসী তোমার ইচ্ছেদের অনুবর্তী প্রতিদিন
ঠিক যেমনটা চেয়েছিলে, তিলোত্তমা শ্রেয়সী
পরিপাটি নিখুঁত সে, মন দেখবার কি দরকার!
সবাক চোখ ঢাকা পড়েছে রঙীন চশমার কাঁচে
হৃদ-কুঠুরে লোহার তালা, গভীর জলের তলায়
ছুঁড়ে দিলাম আলগোছে তার চাবি খানা সোনার
যত-ই খোঁজো তন্নতন্ন, হদিস মিলবে না আর …
যখন ইচ্ছে নৈবেদ্য দাও, ইচ্ছে হলেই ভাসান
পুতুল হাসি পুতুল কান্না, প্রাণের বড় আকাল
মানুষ চাইলে মানুষ পাবে, পুতুল চাইলে পুতুল
মূর্তি গড়ে, মানুষ চাইবে, তাই কখনো হওয়ার?
লুবনা ইয়াসমিন রচিত ও প্রকৃতিপুরুষ কর্ত্তৃক প্রকাশিত কবিতা, মায়া শহরে মধ্যরাত ও অন্যান্য কবিতা — প্রমিত বানান রীতিতে সম্পাদিত।
আপুর কবিতাগুলো অনবদ্য্য।অনেক পড়েন,লিখেন কম।অন্যরকম ভাবাবেগ,প্রকৃতি ও জীবনের এক সরল সমীকরণ। ধন্যবাদ কবিকে।